দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা আমাদেরই সন্তান : তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন

image

You must need to login..!

Description

সনৎ কুমার বিশ্বাসঃ পৃথিবীর সব দেশেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, শিশু রয়েছে। এটা স্বীকৃত যে, কোনো দেশের জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ কোনো-না-কোনোভাবে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধীতার শিকার। আমাদের ১৬ কোটি ২৭ লাখ মানুষের মাঝে প্রায় ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীতার হিসাব দেওয়া খুব সহজ বিষয় নয়।

মা-বাবার একমাত্র সন্তান রাবেয়া। মাত্র তিন বছর বয়সে তার এক চোখে সাদা একটি গোলাকার বিন্দু দেখা যায়। প্রথমে ভয় পেলেও প্রতিবেশীদের আশ্বাসে তারা নিশ্চিন্ত হন, ভয়ের কিছু নেই, কিছুদিন-গ্রামের কবিরাজের ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। খুব বেশি খরচের ব্যাপারও নয়। শুরু হয় চিকিৎসা, কিন্তু এর ফল হয় মারাত্মক, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বিন্দুটি বড়ো হতে হতে পাশের চোখেও ছড়িয়ে পড়ে এবং চোখের দৃষ্টি অনেকটাই ঝাপসা হয়ে আসে। রাবেয়ার ছয় বছর বয়সের সময় একটি বেসরকারি সংস্থা গ্রামের দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে চক্ষুশিবিরের আয়োজন করে। শিবিরের এক ডাক্তারের পরামর্শে সেখানে অস্ত্রোপচারের পর রাবেয়া আজ সম্পূর্ণ সুস্থ্য।

আবারও হাসি-খুশি আর উচ্ছ্বলতায় ভরে উঠেছে রাবেয়ার দিনগুলো। স্কুল পড়–য়া মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে তার মা-বাবাও আজ বিভোর। খুব অল্প বয়সে চিকিৎসা পাওয়ার কারণে রাবেয়ার বড়ো কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে দারিদ্র্য আর অশিক্ষার কারণে তার চোখের যে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারতো তা তার মা-বাবা এখন স্বীকার করেন।

দেশের প্রায় ১৩ লাখ শিশু চোখের সমস্যায় ভুগছে। এদের মধ্যে ৫১ হাজার ২০০ শিশু অন্ধ। এসব অন্ধ শিশুর ২০ হাজার ৪৮০ জনের অন্ধত্ব প্রতিরোধযোগ্য। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির কারণে শিশুদের লেখাপড়াসহ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। হীনমন্যতায় ভোগে শিশু। এসব সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে একটি দিবসের সূচনা করে। এটিই ১৯৬৪ সালে সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর সাদাছড়ি দিবস পালন করা হয়। International Federation of Blind বর্তমান  WorldBlind Union ১৯৬৯ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় প্রথম বিশ্ব অন্ধ সম্মেলনের আয়োজন করে যা ঐ বছর ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে বাংলাদেশে প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭০ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ব সাদাছড়ি দিবস পালন করা হচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে। আমাদের ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। অজ্ঞতা, অন্ধকারাচ্ছন্নতা, অশিক্ষা কিংবা অসচেতনতা যাই বলি না কেনÑ সুদৃষ্টি পেলে এ ধরনের বিপদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কিংবা সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্ভব।

বিশ্বে ক্রমাগত উন্নয়ন ঘটছে, হোক অর্থনৈতিক, হোক প্রযুক্তিগত। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীতাকে জয় করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়- সম্পূর্ণ অন্ধ বা স্বল্প বা তীব্র মাত্রায় দৃষ্টিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি যারা চশমা বা লেন্স ব্যবহার করেও ভালোভাবে দেখতে পান না – তারা সবাই দৃষ্টি প্রতিবান্ধী হিসেবে পরিচিত। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য, চলাচলের সুবিধার্থে Global Position Navigation System  চালু আছে। এর মাধ্যমে তাদের চলাচল হয়েছে আধুনিক ও সহজ।

বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা চলার ক্ষেত্রে সাদাছড়ি ব্যবহার করে থাকে, এটিই তাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। বিষয়টি আরো গতিশীল করতে ১৯৭৫ থেকে প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর “বিশ্বসাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবস” পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বের প্রায় ২৮.৫ কোটি মানুষ এখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং বাংলাদেশে অন্ধত্বের হার প্রতি হাজারে ০.৭৫ ভাগ। বাংলাদেশে ৬ কোটি ৭০ লাখ শিশু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ শিশুর দৃষ্টি ত্রুটি রয়েছে এবং ৫১ হাজার ২০০ জন শিশু অন্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাথমিক পর্যায়ের স্বল্প মাত্রায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীতা প্রতিরোধ বা প্রতিকারের অভাবে মানুষ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ একটু সচেতন থেকে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের প্রায় ৮০ শতাংশকেই সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

আমাদের দেশের শিশুদের চোখের সমস্যা বাড়ছে, এর মধ্যে শহরের বাচ্চাদের চোখের সমস্যা বেশি। চোখের বিভিন্ন সমস্যার কারণে স্কুলে শিশুদের পড়ালেখা ও অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। চোখের সমস্যার কারণে শিশুরা ক্লাসে মনোযোগ হারায়, নিজেকে গুটিয়ে রাখে। শিশুকে যদি সময়মতো চশমা ও অন্যান্য চিকিৎসা দেওয়া যায় তাহলে শিশুর দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কা থাকে না। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে শিশুদের অন্ধত্ব বরণ করতে হয়। ক্ষীণদৃষ্টির কারণে শিশুরা পড়াশোনা এবং পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের জন্য সহজতর উন্নত জীবনমানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের সাথে সাথে আমাদের সকলের দায়িত্ব। সরকার ইতোমধ্যে দেশের ১৭টি জেলায় একটি করে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্বাচন করে সেখানে তাদের সুবিধার্থে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করার সাথে সাথে শিক্ষা প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ব্রেইল উপকরণ বিতরণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্রেইল উপকরণটি ব্যয়বহুল এবং ইলেক্ট্রনিক রেকর্ডিং ডিভাইসও সহজলভ্য নয়। তাই বিভিন্ন এনজিও, ধনী ব্যক্তিদেরও সরকারের পাশাপাশি কাজ করতে হবে। সাদাছড়ি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিবন্ধীদের নিরাপদে চলাচল নিশ্চিত করতে সহায়তা করা।

চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো জন্মের পরপরই শিশুকে শালদুধ খাওয়াতে হবে। মায়ের বুকের দুধ শিশুর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত খাওয়াতে হবে। শিশু জন্মের পর ইপিআইয়ের সব টিকা নিতে হবে। ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের ৬ মাস অন্তর উচ্চক্ষমতা ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে। শিশু দেখতে পায় না এ ধরণের কিছু বুঝতে পারলে শিশুর চোখের মনি সাদা হলে, শিশুর চোখে আঘাত লাগলে সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে। শিশুর চোখে চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।

সাদাছড়ির বিষয়টি এখন মোটামুটি সকলেই জানে। সাদাছড়ির গুরুত্ব সম্পর্কে যানবাহন চালককে সাবধান করে তুলতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ বেশ আন্তরিক। তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সময় শর্ত হিসেবে তাদের কর্মসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। জাতিসংঘে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদের ১৮ নম্বর ধারায় চলাচল ও জাতীয়তার স্বাধীনতার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং-এ পারাপারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ পথচারীরাও পারেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করতে।

গ্লোবাল একশন প্ল্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতিরোধযোগ্য দৃষ্টিজনিত সমস্যা বর্তমান অবস্থা থেকে ২৫ শতাংশে কমিয়ে আনতে দৃষ্টি সমস্যার নানান মাত্রা ও এর কারণ নির্ণয় করার সাথে সাথে চিকিৎসক ও ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সকলের জন্য চক্ষুসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের প্রায় ৯০ ভাগ ঘটনা ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। অপুষ্টি, চোখের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা এবং চিকিৎসার অভাবে সমস্যাগুলো বেশি পরিলক্ষিত হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পিছিয়ে পড়ছে, তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থবির হয়ে যাচ্ছে। একসময় রাষ্ট্রই তাদেরকে ‘বোঝা’ হিসেবে দেখবে যা উন্নয়নের পথে বাধা।

জাতীয় অন্ধ ও ক্ষীণ দৃষ্টি সম্পর্কিত জরিপ ২০০০ অনুযায়ী বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত লাখ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রেই মূল কারণ চোখের ছানি। প্রতিবছর নতুন করে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতিসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫১ হাজার, যার মধ্যে ১২ হাজার শিশু সম্পূর্ণ অন্ধ। যদিও নতুন করে এখনো জরিপ হয়নি। ধারণা করা হয় এই সংখ্যা ৩৫ থেকে ৩৬ হাজারে নেমে এসেছে।

উন্নত প্রযুক্তি ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে তুলেছে। আমাদের সমাজে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের স্বাভাবিক প্রবণতার মাধ্যমে আমরা সে অভাব পূরণ করতে পারি। অল্পবয়সী রাবেয়ার মতো শিশুদের সময়মত চিকিৎসা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য অন্ধত্ব নিবারণ করা সম্ভব। তবে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, সহানুভূতিশীল আচরণের মাধ্যমে এসব সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। আসুন এবারের বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবসে আমরা সেই বিশ্বাসেই বলীয়ান হই।    লেখক: প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ ।

 

প্রধান সম্পাদকঃ
মতিউল আলম

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ
মাকসুদা আক্তার