You must need to login..!
Description
উবায়দুল হক, ময়মনসিংহ, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়ে গ্রামে জনমত গড়ে তুলছিলেন মধু সূদন ধর। আর তার ছেলে সুপ্রিয় ধর বাচ্চুও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নিচ্ছিলেন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। বিষয়টি জানতে পেরে হানাদার বাহিনী মধু সূদনকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তার খোঁজ পায়নি পরিবার।
এ ঘটনার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে ভারতে চলে যান সুপ্রিয় ধর। এরপর জীবনের নিরাপত্তায় ভারতে পাড়ি জমান সুপ্রিয় ধরের মা ও অন্যান্য ভাই বোনেরা। পরে স্বাধীনতার পর দেশে ফেরেন তারা। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও মধু সূদনের সেই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি পায়নি পরিবার।
মধু সূদন ধরের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের শালীহর গ্রামে। তিনি ১৯৪২ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকের সশস্ত্র কর্মী ছিলেন মধু সূদন। আর তার স্ত্রী কমলা ধরও ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মহিলা ব্রিগেডের সদস্য।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুধু সূদন নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। আর তার ছেলে সুপ্রিয় ধর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তৎকালীন গৌরীপুর মহাবিদ্যালয়ে ৩০ সদস্যের দলে অংশ নিয়ে নিচ্ছিলেন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। এই কারণে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীরা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।
মুধু সূদন ধরের বড় ছেলে সুপ্রিয় ধর বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শোনেই আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেই। সেই ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহে ইপিআরের লুট হওয়া অস্ত্র থেকে ১৫ থ্রি নট রাইফেল আমরা পাই। ৪ এপ্রিল থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন পাকিস্তান আর্মির সদস্য আক্কাছ আলী, আব্দুল হেকিম, রেডিও মেকার মমতাজ উদ্দিন ও গৌরীপুর মহাবিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আলী হাসান। ২৩ এপ্রিল পাকবাহিনী গৌরীপুর বিমান হামলা করলে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই।
এদিকে পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে জেলা শহর থেকে বহু মানুষ মধু সূদনের শালীহর গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৫ মে রাতে তাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ করলে পরের দিন ১৬ মে দুপুরে বিশেষ ট্রেনে পাকবাহিনী গৌরীপুর স্টেশনে এসে মধু সুদনের বাড়িতে অভিযান চালায়। গ্রামের বহু মানুষ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন।
মধুসূদন ধর বুঝতে পেরেছিলেন তাকে নিয়ে যেতে না পারলে পাকবাহিনী পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। তিনি গ্রামবাসীকে শান্ত করে হানাদার সেনাদের সঙ্গে চলে যান। এরপর কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে শেরপুর সীমান্ত হয়ে সুপ্রিয় ধর ভারতে চলে যান। অন্যদিকে কমলা ধর তিন সন্তান নিয়ে সিলেট সীমান্ত হয়ে ভারতে চলে যান।
সুপ্রিয় ধর বাচ্চু বলেন, হানাদার বাহিনী যখন আমাদের বাড়িতে আসে তখন আমি আর বাবা বাড়ির পেছনে ছিলাম। হানাদার বাহিনীকে দেখে বাবা আমাকে পানের বরজে ঢুকে যেতে বলে চলে যান। এরপর বাবাকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এরপর বাবা আর ফিরে আসেননি।
তিনি বলেন, ভারতে যাওয়ার পর এক পিসে মশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মায়ের সঙ্গে দেখা করি। পরে স্বাধীনতার পর দেশে আসি।
সুপ্রিয় ধর বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানতে পারি ‘বাবাকে নিয়ে যাওয়া ট্রেনটি ভৈরবের দিকে যায়। পরে জানতে পারি, ওই ট্রেনে বাবার সঙ্গে গৌরীপুর প্রতিমা সিনেমা হলের মালিক কৃষ্ণ লাল সাহাকেও নিয়ে যায় পাকবাহিনী। পরে রেলপথের মুসল্লি সেতুর নিচে সেনারা অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পর মুসল্লি গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, বাবাকেও ওখানে হত্যা করা হয়েছে। বাবার গায়ের শার্ট আর আংটির বর্ণনা শুনে আমার এমনটাই মনে হয়েছে।
তিনি জানান, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের পরিবারের কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকার অনুদান দিয়েছিলেন।
বাবাকে হারিয়ে আমাদের পরিবারের নেমে আসে জীবন সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। সুপ্রিয় ধর বলেন, সংসারের পুরো দায়িত্ব আসে মায়ের ওপর। তৎকালীন সময়ে ৫০০ টাকা বেতনে পরিবার পরিকল্পনায় চাকরি করতেন। মায়ের সেই বেতন আর কিছু কষিজমি ছিল আমাদের। তা দিয়েই মা সংসার চালিয়েছেন। ছোট ভাই ঢাকা কলেজে পড়তো, তার পড়াশোনার খরচও দিতে হয়েছে। যদিও পরে সে টিউশনি করিয়ে পড়াশোনার খরচ বহন করতো। আমি তখন ময়মনসিংহের একটি ক্লাবে ফুটবল খেলতাম। সেখান থেকেও কিছু উপার্জন হতো। সেখান থেকে ছোট ভাইকে সহযোগিতার চেষ্টা করেছি।
মধুসূদন ধরের স্ত্রী কমলা ধর জীবিত নেই। বড় ছেলে সুপ্রিয় ধর গৌরীপুরে, বড় মেয়ে সুপ্রিয়া ধর রাজশাহীতে থাকেন। ছোট ছেলে সুব্রত শংকর ধর বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে থাকেন ও ছোট মেয়ে সুপ্রীতি ধর বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।
মধু সূদন ধরের স্মৃতি রক্ষায় স্বাধীনতার পর শালীহর গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম রাখা হয়েছে শহীদ মধু সূদন ধর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে তার নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সরকারি তালিকায় নেই।
আক্ষেপ করে সুপ্রিয় ধর বলেন, স্বাধীনতার এতোদিন আমার বাবার আত্মত্যাগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন স্বীকৃতিটা মায়ের চাওয়া ছিল। কিন্তু আজও সেটি পাওয়া হলো না।