You must need to login..!
Description
মো. রিদওয়ানুর রহমান রুবাইয়াৎ
সমগ্র মুসলিম জাহানের জন্য কোরবানির ঈদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোরমধ্যে অন্যতম। আর কোরবানির ঈদের প্রধানতম অনুষঙ্গ হচ্ছেপশু কোরবানি। রমজানের ঈদ যেমন দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার প্রতিআনুগত্য প্রকাশের পর আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে আসে তেমনি কোরবানির ঈদও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে এ দিনে কোরবানির কারণে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে সমস্ত সামর্থ্যবান মুসলমান এই দিনটিতে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করে থাকেন। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎমুসলিম প্রধান দেশ। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে এ দেশের মুসলিম সমাজও কোরবানির মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বের মত মহিমান্বিত এই দিনের মর্যাদা রক্ষায় আর সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টায় নিজেকে সামিল করেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে আল্লাহ কর্তৃক সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি করতে আদিষ্ট হয়ে যখন প্রিয়পুত্র হযরতইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করতে উদ্যত হন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে,ইসমাইল (আ.) এরপরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার কোনো ক্ষতি হয়নি। ঐতিহাসিক এই ধর্মীয় ঘটনাকে স্মরণ করে সারাবিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরবানি করে থাকেন। চন্দ্র মাস জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানি করার সময় নির্ধারিত থাকলেও বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা মূলত কোরবানির ঈদের দিনেই আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায়ে কোরবানি দেন।
মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে কোরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। মুমিন মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত দিনে কোরবানি করা মহান আল্লাহর নির্দেশ। কোরবানির মধ্য দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। হাদিস মোতাবেক, কোরবানিকৃত পশুর প্রতিটি পশমএর পরিবর্তে একটি করে নেকির য়েছে। আবার কোরবানি না করে কোরবানির টাকা গরীব-দুঃখীর মাঝে বিতরণ করে কোরবানির হক আদায় হয় না বলেও কোরবানির তাৎপর্য অপরিসীম।
আমাদের দেশে কোরবানির গুরুত্ব বিবেচনায় কোরবানির পশু সরবরাহে একটি বিরাট ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান রয়েছে। কোরবানির জন্য পশু সরবরাহে বর্তমানে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিপুল সংখ্যক খামারি যেমনএর সাথে সম্পৃক্ত, তেমনি কোরবানির পশুলালন-পালনের জন্য খাদ্য ও ওষুধনির্মাতা, পশুচিকিৎসক, সরকারি ও বেসরকারি সেবা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শদাতারাও কোরবানির পশু উৎপাদনে দেশের অর্জিত সামর্থ্যরে পেছনে কাজ করছে। আবার দেশে উৎপাদিত কোরবানির পশুপুষ্টিমান ও গুণে আমদানিকৃত পশুর তুলনায় ভালো। ফলে দেশীয় খামারীদের উৎসাহিত করতে এবং অধিক পরিমাণে পশু উদ্যোক্তা ও খামারী তৈরিতে সরকারও কোরবানির জন্য পশু আমদানিতে নিরুৎসাহ প্রদর্শন করছে।
গত ১৪ জুন তারিখে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানান, এবারের কোরবানির ঈদে সারাদেশে কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা আছে ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯ টি। আর কোরবানির জন্য দেশে পশু আছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩ টি; যাগত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ১১ হাজার বেশি। এই হিসেবে এবার চাহিদার চেয়ে কোরবানির পশু ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪ টি বেশিআছে। মোট কোরবানির পশুর মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজারের বেশিগরু-মহিষ, প্রায় ৭৭ লাখছাগল-ভেড়া এবং আড়াই হাজারের বেশি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু রয়েছে। আবার, গত ১২ জুন ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত আসন্ন ঈদুল আযহা ২০২৩ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক প্রস্তুতিমূলক সভায় জানানো হয়, ময়মনসিংহ বিভাগেও চাহিদার চেয়ে পশুর উৎপাদন বেশি হয়েছে। বিভাগে ৩ লাখ ৮৬ হাজার পশুর চাহিদার বিপরীতে কোরবানির জন্য প্রস্তুত পশুরসংখ্যা ৫ লাখ ৩৩ হাজার বলে জানানো হয়। সভায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যেনপশু দেশের বাজারে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়।
বর্তমানে দেশের প্রত্যন্ত পর্যায় পর্যন্ত কোরবানিকে উদ্দেশ্য করে স্থানীয়ভাবে কোরবানির হাট বসে। স্থানীয় পর্যায়ে গরুর খামারিরা এসব হাটে নিজেদের পশু নিয়েআসেন। বড় উদ্যোক্তা ও খামারীরা স্থানীয় হাটের পাশাপাশি রাজধানী ও বিভাগীয় পর্যায়ের বড় হাটগুলোতেও নিজেদের পশু সরবরাহ করেন। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় কোরবানি কেন্দ্রিক এসবপশুরহাট দু’একটি বিচ্ছিন্ন অব্যবস্থাপনার কথা বাদ দিলে মোটামুটি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে। সুষ্ঠু হাটব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট সংখ্যক হাটবসার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরী। ২০২৩ সালে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহবিভাগীয় পর্যায়ের চার জেলায় ১৯০টি স্থায়ী ও ২৪৯টি অস্থায়ী মিলিয়ে ৪ শতাধিক কোরবানির হাটবসবে। ময়মনসিংহের স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানাযায়, নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশিহাট যেন না বসে সে বিষয়ে নজরদারিকরা হবে।
পশু কোরবানির আগে প্রস্তুতি স্বরূপ পশুজবাই ও মাংস বানানোর কাজে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, যেমন চাপাতি, দা, ছুরি-চাকু, চাটাই ও খাইট্টা হাতের নাগালে রাখতে হবে। পশু কোরবানীর স্থাননির্ধারণ করে ছুরি, দা প্রভৃতিধার দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোরবানির আগে পশুকে প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়াতে হবে। এতে পশুর চামড়া ছাড়াতে সুবিধা হয়। পশু কোরবানির পর জায়গাটিপানি ঢেলে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে, যাতে গন্ধ সৃষ্টি হয়ে পরিবেশ দূষিত না হয়। হাড়গোড়, নাড়িভুঁড়ি, চামড়ার কাটা অংশ নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করে রাখতে হবে, যাতেপরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিয়ে যেতেপারে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাব থাকলে ময়লা-আবর্জনা একসঙ্গে জড়ো করে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। কোরবানির পশুর চামড়া সঠিকভাবে ছাড়াতে পারলে এর মান ও দাম ঠিক থাকে। পশু জবাই করার পর দক্ষ লোক দিয়ে চামড়া ছাড়াতে হবে। চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণের পর্যাপ্ত যোগান ঠিক রেখে প্রয়োজন অনুসারে চামড়ায় লবণ ব্যবহার করতেহবে।
দেশের প্রায় অর্ধেক চামড়া কোরবানির সময় পাওয়া যায়, তাই সঠিকপদ্ধতিতে কোরবানি, চামড়া ছাড়ানো ও চামড়ার রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার প্রতিবছর কোরবানির আগে কসাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে, যাতে সঠিক পদ্ধতিতে কোরবানি এবং পশু চামড়ার গুণগতমান ঠিক রাখা যায়। এ বছর ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২২২৪ জন কসাইকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কোরবানির পর বর্জ্য অপসারণ প্রতিটি অঞ্চলের স্থানীয় প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যেকারণে জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় নিয়ে কোরবানির অনেক আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে প্রস্তুতি শুরু হয়। লোকবল ও অন্যান্য সুবিধাদি ঠিক রেখে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে কোরবানির বর্জ্য অপসারণের বিষয়টি সম্পাদনের টার্গেট নেয়াহয়। বর্জ্য অপসারণের দায়িত্বে থাকা রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনগুলোর মত ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কোরবানির ২৪ ঘন্টারমধ্যে বর্জ্য অপসারণের টার্গেট গ্রহণ করেছে। তবে কেবল স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নয় কোরবানির বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও জরুরি। কোরবানির বর্জ্য যেন দ্রুততম সময়ে অপসারণ সম্ভব হয় সেজন্য নিজনিজ বাড়ির কোরবানির বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে যেন জমা থাকে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টিহতে দেখা যায়। প্রচন্ডযান জটের কারণে সৃষ্টি হয় জনদুর্ভোগের। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানির গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য যেমন অপরিসীম, তেমনি মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে আমাদের কাছেএর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় তাৎপর্যও অনেক। আবার কোরবানিকৃত পশু ও এরচামড়া দেশের অর্থনীতিতেওএকটিবড়অবদান রেখেচলেছে। কোরবানিকেন্দ্রিক সার্বিকসমন্বিতব্যবস্থাপনারমধ্য দিয়ে কোরবানির সময়ে যে কোনো প্রকারের জন দুর্ভোগের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ