You must need to login..!
Description
স্টাফ রিপোর্টার, বিএমটিভি নিউজঃ
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দিনভর ও সন্ধ্যার পর থেকে টানা বর্ষণে ড্রেন উপচে ময়মনসিংহে নগরীর বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।ফলে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সরকারি হাসপাতাল, বাসাবাড়ি, বিপণি বিতানে পানি প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে নগরবাসী। এদিকে দ্রুত পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে একটি টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।স্থানীয়রা জানান, গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও বুধবার রাতভর এবং বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়। বিকেল থেকে বর্ষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে নগরীর ড্রেনগুলো উপচে বাসাবাড়ি, বিপণি বিতানে পানি প্রবেশ করেছে।
এছাড়াও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে পানি স্টাফ কোয়াটারগুলোর নিচতলা পানি ঢুকে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর দিয়ে চিকিৎসা সেবা চালু রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. জাকিউল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রচণ্ড বৃষ্টিতে পানি বেড়ে গেছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলপথ পানিতে তলীয় যাওয়ায় সিগন্যাল পয়েন্ট কাজ করছে না। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন হচ্ছে। রেলওয়ের পরিবহণ বিভাগের পরিদর্শক মো. শাহীনুর ইসলাম বলেন, পানিতে লাইন তলিয়ে থাকায় সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেন পার করতে হচ্ছে।
এদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কন্ট্রোল রুমে পানি উঠে পড়ায় রাত সোয়া ৯টা থেকে নগরীর প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট গ্রিড অব কোম্পানি (পিজিসিবি) নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল হক বলেন, টানা বর্ষণে পুরো গ্রিডে পানি উঠলেও এখনও নিরাপদ স্থানে রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবির) প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, কেওয়াটখালী কন্ট্রোল রুমে পানি উঠে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টা থেকে নগরীর ৫০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। দমকল বাহিনীকে খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে পানি না কমলে পরিস্থিতি ঠিক হবে না।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ অবস্থা বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি কিছুটা কমায় কিছু কিছু এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। দ্রুত পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে একটি টিম করে দেওয়া হয়েছে। ভয়াবহ বৃষ্টি হওয়ায় মানুষের সাময়িক কষ্ট হচ্ছে।
নগরী ব্রাক্ষপল্লী এলাকায় বাসার হাঁটু পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন পলি (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ এছাড়া উপজেলায় তলিয়ে গেছে ধানক্ষেত। ভেসে গেছে পুকুর-ঘেরের মাছ। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ নগরীর গাঙ্গিনারপাড়, ধোপাখলা, চরপাড়া, নতুন বাজার, স্টেশন রোড, নয়াপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী, কালিবাড়ি, গুলকিবাড়ি, আমলাপাড়া, ভাটিকাশর৷ কালিবাড়িসহ নগরীর অনেক এলাকা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমেছে। এসব এলাকার বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি উঠেছে। অনেক পরিবার নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। নগরীর বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে।
নগরীর ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় আটকে পড়া ইমরুল হাসান ইমন বলেন, ভাবি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার জন্য বাসা থেকে খাবার আনতে শিকারিকান্দা এলাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাঁটু সমান পানিতে আটকা পড়েছি। বৃষ্টিতে সড়কে গাড়িও চলছে না।
নগরীর গোলাপজান রোড এলাকায় একটি ছাত্রাবাসে থাকেন আনন্দমোহন কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান। সেখানে পানি ওঠায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। এমন অবস্থা পুরো নগরজুড়েই।
এদিকে, রাত ১০টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালী এলাকার পাওয়ার গ্রিডের কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তিন ঘণ্টায় কন্ট্রোল রুমের পানি সেচে বের করেন। এ ঘটনায় বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাত ২টার পর আবার কন্ট্রোল রুমে পানি জমে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিড বন্ধ আছে। এতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে নগরীর বেশ কিছু এলাকা।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ ফায়ার স্টেশন কর্মকর্তা জুলহাস উদ্দিন বলেন, রাত ১০টার দিকে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিড থেকে খবর আসে কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকেছে। এমন খবর পেয়ে ৩ ঘণ্টা সেচে পানি সরানো হয়। রাতে আবারও কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকেছে শুনেছি।
ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (দক্ষিণ) নির্বাহী প্রকৌশলী ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে কেওয়াটখালী পাওয়ারগ্রিড়ের কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকে বন্ধ আছে। এতে নগরীর স্টেশন রোড, পাদ্রী মিশন, চরপাড়াসহ বেশকিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে। ঠিক হতে কত সময় লাগবে তা এখন বলা যাচ্ছে না।
সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া এলাকায় অন্তত ৫০০ একর ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, আমি ৮ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। গত রাতের বৃষ্টির পানিতে সব তলিয়ে গেছে।
একই এলাকার নেকবর মিয়া বলেন, আমি চার কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার সব পানিতে তলিয়ে গেছে।
সদর উপজেলার চর হরিপুর এলাকার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ১০ শতাংশের পুকুর ডুবে সব মাছ ভেসে গেছে। পুকুরে ৫০ হাজার টাকার মাছ ছিল।
একই এলাকার শামীম আহমেদ বলেন, আমার প্রায় ৩০ কাঠা ধানি জমি তলিয়ে গেছে। তবে, আমার কোনো ফিসারি না থাকায় বেঁচে গেছি। এ গ্রামে অন্তত ৩০০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। বাড়ি ঘরেও পানি উঠেছে।
একই এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, বাড়ির চারপাশে অপরিকল্পিত পুকুর ও ফিসারি। এই কারণে বাড়ি ঘরে পানি উঠে গেছে। গরু ছাগল নিয়ে বিপাকে আছি। রান্না ঘরে পানি উঠায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
লিপি আক্তার বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতেই বাড়ি ঘর তলিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে খুব বিপদে আছি। চারপাশে অপরিকল্পিত ফিসারির কারণে আজ আমাদের এই দুর্দশা।
চর হরিপুর এলাকার জয়নাল বলেন, ১৭ কাঠা জমি লিজে নিয়ে ফিসারি দিয়েছি। এক রাতের বৃষ্টিতে সব ফিসারি তলিয়ে গেছে। মাছ যেন ফিসারি থেকে না যেতে পারে তাই নেট জাল দিচ্ছি। আমার অন্তত ১৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
চর হরিপুর মজিবুর রহমান বলেন, এমন বৃষ্টি দেখছি বহুবার কিন্তু এভাবে পানি জমতে দেখিনি কখনো। আমার ১০ কাঠা ধানের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ১২ কাঠা জমিতে ফিসারি ছিল। সব ফিসারি তলিয়ে গেছে। আমার অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে।
একই এলাকার মরম আলী বলেন, আমার ১৭ কাঠা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ১৫ কাঠা ফিসারির মাছ ভেসে গেছে। চর হরিপুর, বাজিতপুর ও আলালপুর গ্রামে অন্তত হাজার একর ফিসারি তলিয়ে গেছে।
জেলার গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কাঠবাড়ি এলাকার এরশাদুল বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতে আমার এক কাঠা মেহগনি গাছের বাগান ভেসে চলে গেছে। একটা ফিসারিতে দুই লাখ টাকার মাছ ছিল। তাও ভেসে গেছে।
গফরগাঁও পৌর শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১ ও ২ নম্বর গলির বেশিরভাগ বাসা বাড়িতে পানি ঢুকেছে। পৌরশহরের প্রতি ওয়ার্ডে কম বেশি রাস্তার ওপরে পানি উঠেছে। এছাড়া উপজেলার অনেক এলাকার ফিসারির মাছ ভেসে গেছে পানিতে। ধানি জমিতেও পানি জমেছে।
ওই উপজেলার চরআলগী ইউনিয়নের চর কামারিয়া নদীর পাড়ে এক মাস আগে ছোট ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল। যা গত রাতের বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। এতে স্থানীয়দের চলাচলের বিঘ্ন ঘটছে।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মতিউজ্জামান বলেন, জেলার সব উপজেলায় ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে। তবে পরিমাণ ধানক্ষেত তলিয়েছে তার কোনো হিসাব এখনো করা হয়নি। পানি নেমে গেলে হিসাব করা যাবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত রাতের বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিরা। ১৩ উপজেলায় প্রচুর ফিসারি তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া প্রতি উপজেলায় অনেক ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে হিসাব সংগ্রহ করছি। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
###
মতিউল আলম