You must need to login..!
Description
মোঃ মাসুদ মিয়া:
সম্প্রতি উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। সরকারি হিসাবে দেশের ১১টি জেলা বন্যাকবলিত। এগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। বন্যাকবলিত এসব জেলায় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে উদ্ধারকাজ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনে একযোগে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে এবং সারা দেশের সচেতন নাগরিকবৃন্দ ত্রাণকাজে সহযোগিতা করছেন। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সহযোগিতা করছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সংগঠন । জাতির এমন ক্রান্তিলগ্নে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের একাত্ম হয়ে কাজ করার দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। ত্রাণকাজে সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ‘গণত্রাণ সহায়তা কর্মসূচি’ বুথ খুলেছে। এতে সারা দেশের মানুষ অর্থ, খাদ্য ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য এমনকি পোশাক পৌঁছে দেয় স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রদের কাছে। সেখানে সাহায্য নেওয়ার জন্য নয়, দেওয়ার জন্য মানুষের লম্বা লাইন দেখা গেছে। অন্যান্য সময় টিএসসিতে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য যানজট দেখা দিলে ছাত্ররা বিরক্ত হতো, কিন্তু এসময় আনন্দ লেগেছে। টিএসসি এলাকায় ক্ষণে ক্ষণে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, ‘চলাচলের রাস্তায় ভিড় করবেন না, শৃঙ্খলা বজায় রাখুন’। শুধু বিত্তবানরা নয়, সকল শ্রেণির সাধারণ জনগণ সাধ্যমতো সহায়তা করেছেন। একজন ভিক্ষুক যে কিনা নিজেই অন্যের সাহায্যে দিনাতিপাত করে, সেও বন্যাদুর্গতদের সহযোগিতার জন্য দান করছেন। ১০ বছরের এক শিশু তার টাকা জমানোর ব্যাংক নিয়ে এসেছেন টাকা দেওয়ার জন্য। একজন রিকশাচালক তার সারাদিনের ইনকাম দিয়ে দিচ্ছে সহায়তা কেন্দ্রে। সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে গত ২৩ আগস্ট টিএসসিতে মোট নগদ অর্থ কালেকশন হয় ১ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার ১৭২ টাকা, পরদিন (২৪ আগস্ট) তা আরো বেশি, প্রায় ২ কোটি ২৫ লক্ষ ৪৭ হাজার ৪৭০ টাকা। এমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বহু বছর দেখেনি কেউ। শিক্ষার্থীরা অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য দানকারীর নাম, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার খাতায় এন্ট্রি করে রাখছে। শুধু অর্থই নয়, বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, স্যালাইন, ওষুধ, গো-খাদ্য, স্যানিটারী ন্যাপকিন, পোশাকসহ আপদকালীন সব ধরনের সরঞ্জাম জমা পড়েছে টিএসসিতে। প্রায় ২০০ জন শিক্ষার্থী দিনরাত এসব তদারকি ও প্যাকেজিং এর কাজ করছে। টিএসসিতে এখন কোনো প্রেম নেই, সবই মানবপ্রেমের চিত্র।
মানুষ দান করার জন্য হন্যে হয়ে একটি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম খুঁজতেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৪০ টি ডিপার্টমেন্ট নিজ উদ্যোগে এবং অ্যালামনাইদের সহায়তায় ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ সরবরাহ করে। এছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করা আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। শাইখ আহমাদুল্লাহ এর নেতৃত্বে কাজ করা এ সংগঠনে দেশ ও বিদেশের অসংখ্য মানুষ এমনকি হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষও অনুদান পাঠায়। আর তাতেই একদিনে প্রায় ২০ কোটি টাকা অনুদান আসে সহায়তার জন্য। আপনি জেনে অবাক হবেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে মানুষ স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্য লম্বা লাইন লেগে যায় এবং কেউ কেউ স্বেচ্ছাসেবক না হতে পেরে মন খারাপ করে ফিরে আসে। এসব ছাড়াও সারা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক সংগঠন এবং ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জাতীয় দুর্যোগে এমন একতা যে জাতির, সে জাতিকে রুখে এমন সাধ্য কার!
ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলায় ভয়াবহ বন্যায় এখন পর্যন্ত ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছেন ১৮ জন। আকস্মিক এ বন্যায় দায় রয়েছে অনেকেরই। বন্যার এমন ভয়াবহতার কারণ সম্পর্কে আইনুন নিশাত বলেন, ৩০ বছর আগেও কুমিল্লা ও ফেনীতে প্রতি বছর বন্যা হতো। বন্যার কারণে গোমতীকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ। এখন বন্যা না হবার কারণ হচ্ছে বাঁধ পানি ধরে রাখে। এই বাঁধটা ভারত করেছিল তাদের উপকারের জন্য, তাতে আমাদেরও কিছু উপকার হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা বিষয়ক হেলসিঙ্কি সনদ-১৯৯২ অনুযায়ী, আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর উপর বাঁধ নির্মাণ করতে হলে উজানের দেশ ভাটির দেশগুলোর চাহিদা ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় রাখবে এবং আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত একতরফাভাবে গঙ্গা নদীর উপর বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৬ কিলোমিটার উজানে ভারতীয় অংশে ফারাক্কা বাঁধ, সিলেট সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ১০০ কিলোমিটার উজানে বরাক ও তুইভাই নদীর মিলনস্থলে টিপাইমুখ বাঁধ, লালমনিরহাট থেকে তিস্তার ৬০ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা বাঁধ, কুমিল্লার অদূরে ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডাম্বুর বাঁধ নির্মাণ করে পানি নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ইচ্ছামতো পানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে খরা, অনাবৃষ্টি দেখা দেয় এবং ফসল ফলানো ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে, বর্ষার মৌসুমে অতিরিক্ত পানি যখন বাঁধের উপরে উঠে যাবার উপক্রম হয়, তখন আকস্মিক বাঁধ খুলে দেয় এবং এদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করে এর সুষ্ঠু সমাধান জরুরি। এছাড়াও নদীর নাব্যতা হ্রাস ও পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি, সিলেটসহ হাওর এলাকার অপরিকল্পিত উন্নয়নকেও এর জন্য দায়ী করেন অনেকে।
আকস্মিক বন্যায় ফেনীসহ ১২ জেলার অনেক এলাকা এখনো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। কুমিল্লার গোমতীর বাঁধ ভেঙে বুড়িচং উপজেলার অন্তত ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সরকারি হিসাবে, ১১ জেলায় বন্যায় ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯টি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। এছাড়া বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৮ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সংকট মোকাবিলায় সরকার ৩ হাজার ১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ মানুষ। এছাড়া ১৭ হাজার ৮৪৮টি গবাদিপশুকে আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা, ২০ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে ৬৩৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এটা সরকারি হিসাব, এর বাইরে অসংখ্য বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন নিজ উদ্যোগে উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণ সরবরাহ করছে। বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির পথে। ধীরে ধীরে পানি সমুদ্রে নেমে যেতে শুরু করেছে। আশা করি শীঘ্রই দক্ষিণাঞ্চলের এ অচলাবস্থা কেটে যাবে। এরপর শুরু হবে পুনর্বাসন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্যোগের এ ঘোর অমানিশা কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ।
লেখকঃ বিসিএস তথ্য ক্যাডার অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস (পিআইডি), ময়মনসিংহ।