অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরে ঝুলছে তালা

image

You must need to login..!

Description

মেহেদী হাসান আকন্দ:নেত্রকোণা থেকে, 

বিগত সরকার নেত্রকোণা জেলার ১০ উপজেলায় ৩ হাজার ৯৪২টি পরিবারকে উপহার হিসাবে ২শতক জায়গাসহ দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি করে গৃহ নির্মাণ করে দেন। গৃহ নির্মাণের সময় ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আশ্রয়ন প্রকল্পের অধিকাংশ ঘরেই ঝুলছে তালা। স্থানীয়দের অভিযোগ উপকারভোগী নির্বাচনে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বরাদ্দ পাওয়ার পরও ঘরে বসবাস করেন না উপকারভোগীরা। অনেক ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষ এখনো ঝুঁপড়িঘরে বসবাস করেন।

জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার সদর উপজেলায় ৩০৪টি, কেন্দুয়া উপজেলায় ৩২৭টি, দুর্গাপুর উপজেলায় ১৬৯টি, পূর্বধলা উপজেলায় ১২৭টি, কলমাকান্দা উপজেলায় ৪৯৭টি, মোহনগঞ্জ উপজেলায় ২২৭টি, আটপাড়া উপজেলায় ২৭৭টি, মদন উপজেলায় ২৭১টি, বারহাট্টা উপজেলায় ১৮০টি এবং খালিয়াজুরী উপজেলায় ১৫৬৩টি পরিবারকে ০২ শতক করে জায়গাসহ দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি করে গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে ৯৭টি পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে।

সরেজমিনে নেত্রকোণা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের গদাইকান্দি গ্রামে ফরিদা ইয়াসমিনের নামে বরাদ্দকৃত গৃহটি নির্মাণ করা হয়েছে ফরিদা ইয়াসমিনের পৈত্রিকবাড়ির নিজস্ব সম্পত্তিতে। ঠাকুরাকোণা ইউনিয়নের চরপাড়ায় ১২৭টি পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। যার অধিকাংশ ঘরেই ঘুলছে তালা।

স্থানীয়দের অভিযোগ উদ্ভোধনের পর হতে তালাবদ্ধ ঘরগুলোতে এখনো কেউ আসেনি।এখানে একটি গৃহের বরাদ্দ দেওয়া আছে মো. মাসুদ রানার নামে। মাসুদ রানা ঠাকুরাকোণা ইউনিয়নের বর্ণি গ্রামের আনোয়ারুল আলম ওরফে আঙ্গুরের পুত্র। মাসুদ রানা পৈত্রিকসূত্রে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি বর্ণি গ্রামেই অত্যাধুনিক বিল্ডিং বাড়িতে বসবাস করেন।

আরেকটি গৃহটি বরাদ্দ রয়েছে চরপাড়া গ্রামের কোহিনুর বেগমের নামে। কোহিনুর বেগমের স্বামী নয়ন মিয়া চরপাড়া আশ্রয়ন প্রকল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি চরপাড়া গ্রামের মৃত ইসলাম উদ্দিনের পুত্র। নয়ন মিয়ার বড় ভাই সবুজ মিয়া জানান, নয়নের নিজস্ব বাড়ি ও প্রায় ৩০ কাঠা ফসলী ভূমি রয়েছে।নয়ন মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী কোহিনুর বেগমের নামে ঘরটি বরাদ্দ রয়েছে।

বারহাট্টা উপজেলার গরুহাট্টা কাঁচাবাজার সংলগ্ন ৩টি গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। যার ১টি ঘরের বরাদ্দ পানশ্রী রবিন্দ্র সরকার ও স্ত্রী তুলসি রানী সরকার। রবিন্দ্র সরকার বারহাট্টা-নেত্রকোণা রোডে গোপালপুর বাজারে আপ্যায়ন রেস্টুরেন্ট এর মালিক। বারহাট্টা-নেত্রকোণা রোড সংলগ্ন গোপালপুর বাজারে ৯টি গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে রাবেয়া আক্তারের নামে গৃহ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাবেয়া আক্তারের স্বামী সুলতান মিয়া উপজেলা চত্তরে ব্যবসা করেন। বরাদ্দ পাওয়া ঘর থেকে রাবেয়া আক্তারের বাড়ি মাত্র ১ কিলোমিটার দুরে বারহাট্টা-বাউসী রাস্তা সংলগ্ন কান্দাপাড়া গ্রামে। পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে রাবেয়া বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করেন এবং বাড়ি সংলগ্ন ৩টি দোকান ঘর ভাড়া দেন।বারহাট্টা-বাউসী রাস্তা সংলগ্ন কান্দাপাড়া গ্রামে আশ্রয়ন প্রকল্পে মঞ্জিল মিয়া ও তার স্ত্রীর নামে একটি গৃহের বরাদ্দ দেওয়া হয়। মঞ্জিল মিয়া স্ত্রীসহ নেত্রকোণা পৌর এলাকায় নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করেন।আশ্রয়ন প্রকল্পের অধিকাংশ গৃহই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নামে। যাদের নিজস্ব জায়গা এবং বাড়ি রয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ আশ্রয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া উপকারভোগীরা প্রকৃত ভূমিহীন-গৃহহীন কিনা তদন্ত করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা গৃহের বরাদ্দ হাতিয়ে নিয়েছেন তাদের কবুলিয়াত বাতিল করে প্রকৃত ভূমিহীন-গৃহহীনদের নামে কবুলিয়াত করে তাদের পুনর্বাসন করার।

বারহাট্টা উপজেলার শাসনউড়া গ্রামের ভূমিহীন খালেদা আক্তার জানান, নিজস্ব জায়গা না থাকায় অসুস্থ স্বামী ও ২ সন্তানকে নিয়ে রাস্তার পাশে ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করে বসবাস করেন। তারা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন-যাপন করেন। ঘরের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বহুবার গেলেও তাকে ঘর দেওয়া হয়নি। একই গ্রামের রেখা আক্তার জানান, নিজের জায়গা-জমি না থাকায় অন্যের জায়গায় ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করে প্রতিবন্ধী স্বামী ও ৩ মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন। ঘরের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট বহুবার গিয়ে তারা কোন সরকারি ঘর পাননি।

চরপাড়া আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকার সরকারি খাস জমিতে মানিক-সুলতানা দম্পতি ঠাকুরাকোণা ইউনিয়ন পরিষদে নিয়মিত কর প্রদানের মাধ্যমে দীর্ঘদিন বসবাস করতেন। মানিক-সুলতানা দম্পতি আশ^াস পেয়েও ঘর না পাওয়ায় চরপাড়া আশ্রয়ন প্রকল্প সংলগ্ন বাউসী বাজারে সরকারি জায়গায় স্থানীয়দের সহযোগীতায় ঝুঁপড়ি ঘরে বসবাস করেন।

আটপাড়া উপজেলার ভরতোষী গ্রামে আশ্রয়ন প্রকল্পে ৫০টি গৃহের মধ্যে অধিকাংশই ফাঁকা। আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসকারীদের দাবী তালাবদ্ধ গৃহের মালিকগণ রাজনৈতিক প্রভাবে বরাদ্দ পাওয়ায় নিজেদের বাড়িঘর থাকায় তারা এখনো কেউ আসেনি।কেউ কেউ আসলেও নিজেদের নামে বরাদ্দকৃত ঘরটি দেখে আবার চলে যান।

জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জানান, ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসনে বরাদ্দকৃত গৃহে অনিয়ম তদন্ত পূর্বক অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে অথবা অনিয়মের মাধ্যমে গৃহের বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসনে আশ্রয়ন প্রকল্পের এই গৃহগুলো বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানান।