মিয়ানমার থেকে ফিরে মধ্যরাতে নারী ফুটবলারদের সংবর্ধনা

মিয়ানমার থেকে ফিরে মধ্যরাতে নারী ফুটবলারদের সংবর্ধনা

BMTV Desk No Comments

স্টাফ রিপোর্টার, বিএমটিভি নিউজঃ

গতকাল দিবাগত রাত দেড়টায় দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।ফেরার রাতে হাতিরঝিলে অ্যাম্ফিথিয়েটার মঞ্চে আলোকচ্ছটার মাঝে মেয়েরা। প্রথমবারের মতো এএফসি এশিয়ান কাপে জায়গা নিশ্চিত করে এরপর রাত তিনটায় তাদের দেওয়া হয়েছে সংবর্ধনা। ঢাকার ঘুমন্ত শহর যেন জেগে উঠেছে একঝলক আলো আর হাততালির শব্দে। হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটার মঞ্চে তখন ধীরে ধীরে উঠে আসছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা। ক্লান্ত মুখ, কিন্তু তাতে দমে যাওয়ার লক্ষণ নেই। চোখে সাহস, ঠোঁটে হাসি। যেন অজান্তেই বলছেন, ‘আমরা ফিরেছি বিজয় নিয়ে। তবে এখনো পথ বাকি।’ কখনো ঋতুপর্ণার গোল, কখনো রুপণার সেভ…। কিন্তু চোখে লাগার মতো ছিল পুরস্কারের অভাব। কোনো প্রতীকী চেক, অর্থ পুরস্কার, এমনকি একটি ঘোষণাও এল না। যেন আলো আর অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে অনুষ্ঠানের চাকচিক্যই হয়ে উঠেছিল স্বীকৃতির প্রতীক।
অনুষ্ঠান শেষে ঋতু আর মনিকা আবার রওনা দিলেন বিমানবন্দরের পথে। ভুটানে লিগ খেলতে হবে। এটাই তাঁদের বাস্তবতা। বিজয়ের উৎসব শেষে আবার লড়াই। কারণ, এই মেয়েরা জানেন কীভাবে চলতে হয়। আলো খুঁজে নিতে হয় নিজেদের মতো করে।

গত রাত দেড়টায় মিয়ানমার জয় করে ফিরেছেন তাঁরা। প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের টিকিট কেটে তাঁদের এই ফেরাটা হলো বীরের মতো। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি আনা হয় হাতিরঝিলে। গভীর রাতেও হাজারখানেক দর্শক অপেক্ষায় ছিলেন তাঁদের জন্য মুখে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনি নিয়ে। একে একে মঞ্চে ডাকা হয় রুপণা চাকমা, শিউলি, শামসুন্নাহার, আফঈদা, তহুরা, কোহাতি, মনিকা, মারিয়া, ঋতু ও অন্যদের। বাফুফের সদস্যরা তাঁদের বরণ করেন ফুলের তোড়ায়। মেয়েরা মঞ্চে বসেন যেন মাথায় গর্বের অদৃশ্য মুকুট পরে।মেয়েদের ছবি দিয়ে বানানো বড় বড় বিলবোর্ড ও ব্যানারে সাজানো অনুষ্ঠানস্থলকে বর্ণিল করতে চেষ্টার কসুর করেনি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। ডিজিটাল যুগে যাবতীয় ডিজিটাল রংই থাকল পুরোটা। বড় পর্দায় দেখানো হয়েছে মিয়ানমার-কীর্তির খণ্ডছবিগুলো।ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল বক্তব্য শুরু করলে নড়েচড়ে বসেন অনেকে। কোনো ঘোষণা কি তিনি দেবেন? কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি তাবিথ। মেয়েদের প্রশংসাই করে গেছেন নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে, ‘আপনারা দুটি কাজ করেছেন। নতুন করে ইতিহাস লিখছেন এবং আমাদের সমাজের মনমানসিকতা বদলানোর যাত্রায় এগিয়ে নিচ্ছেন।’

কিন্তু বাফুফে সভাপতির কাছ থেকে নগদ কিছু চাইছিলেন দর্শকেরাও। সেই প্রত্যাশা মেটেনি তাবিথ এভাবে বক্তব্য শেষ করায়, ‘যেভাবে আমরা নারী দলের পেছনে ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব। আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের পেছনে আমরা আছি।’বললেন ২০২৬ এশিয়া কাপ, যেটি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বও, তা নিয়ে স্বপ্নের কথা। এখন শুধু ‘মিশন অস্ট্রেলিয়া’ বলে শেষ করেন তাবিথ। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করতে শক্ত কাঠামো লাগে। লিগ আয়োজনসহ সঠিক পরিকল্পনা দরকার। সেসব অনুচ্চারিতই রয়ে গেল বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসেই অভিনব এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। পৃথিবীতে আর কোনো ক্রীড়া দল এভাবে মধ্যরাতে সংবর্ধনা পেয়েছে কি না, সেটাও বিরাট গবেষণার বিষয়।

মঞ্চ আর গ্যালারি পানির ওপর। সে এক অনন্য পরিবেশ। তবে রাত গভীর হওয়ায় তিন পাশে গ্যালারির মাত্র এক–তৃতীয়াংশ ভরেছে দর্শকে। তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন ঋতুপর্ণা, যাঁর জোড়া গোলে মিয়ানমারকে হারিয়ে ইতিহাস লিখেছে বাংলাদেশ। মাঠে চেনালেন নিজের জাত, চিনিয়েছেন মঞ্চেও।দৃপ্ত বার্তায় ঋতুপর্ণা বলেন , ‘আজকের যে পর্যায়ে এসেছি আমরা, এটা একটা টিমওয়ার্ক। ফুটবল কোনো ব্যক্তিগত খেলা নয়। বাংলাদেশের মেয়েরা জানে কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করতে হয়। আপনারা অমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন। আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। আমরা শুধু এশিয়া না, বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যেতে চাই।’

ঋতুর এই আত্মবিশ্বাস ছুঁয়ে গেল প্রধান অতিথি সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে, যাঁর কাছে এই মুহুর্তে দেশের সেরা অ্যাথলেট রাঙামাটির এই মেয়ে। ঋতুকে লক্ষ করে প্রকাশ করেন নিজের উচ্ছ্বাসও, ‘আপনি একটি কথা বলেছেন, আপনারা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন, বাংলাদেশের মেয়েরা জানে কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দৌড়াতে হয়, এটা দারুণ কথা। বাংলাদেশ আপনার জন্য গর্বিত।’কোচ পিটার বাটলার শুরুতেই বাংলায় ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে মন জিতলেন সবার। মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে পরিশ্রম কতটা হয়েছে তা তুলে ধরেছেন। প্রশংসাও করেছেন—তাঁদের ‘এই জয় সম্ভব হতো না যদি মেয়েরা নিজেদের শেষবিন্দুও ঢেলে না দিত।’ উপস্থিত জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হকের কণ্ঠেও ঝরে মেয়েদের দরাজ প্রশংসা। সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি, আরও পেশাদার পরিকল্পনায় মেয়েদের গড়ে তোলা দরকার।

কিন্তু এই অভ্যর্থনা শেষে একটি প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছিল—শুধু ফুলের তোড়া আর সভাপতির বক্তব্য অনুযায়ী ‘আপনাদের পেছনে আছি’ কথাই কি যথেষ্ট? গত বছর সাফ জয়ের পর মেয়েদের দেড় কোটি টাকা বোনাস দেবে বলেছিল বাফুফে, কিন্তু ৯ মাস পেরোলেও এখনো কানাকড়িও খেলোয়াড়েরা পাননি। এবার তাই হয়তো কোনো ঘোষণাই এল না।এই মেয়েরা যাঁরা আজকের গর্ব, তাঁদের জন্য ঘরোয়া লিগ নেই। নেই প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ বা কোনো টুর্নামেন্ট। সর্বশেষ লিগ হয়েছে গত বছর মে মাসে, তারপর একটাও আয়োজন হয়নি। অথচ মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়া পেরিয়ে এশিয়ায় পৌঁছার দরজা খুলেছেন। নতুন পথও দেখিয়েছেন। পথটা মজবুত করার বড় দায়িত্ব এখন বাফুফের।তবু এই রাত মনে থাকবে। এই রাত শুধু ক্লান্তি নয়, মেয়েদের কাছে আত্মসম্মান আর অঙ্গীকারেরও। রুপণা, ঋতু, আফঈদারা জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশ শুধু ‘বন্যার দেশ’ নয় এখন আর, এটা ‘ফুটবলের দেশ’ও। আর তাঁদের পাশে দাঁড়ানো এখন শুধু উৎসবের দায়িত্ব নয়, প্রয়োজনীয় সমর্থন দেওয়া সময়ের দাবিও।