বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম স্বাধীন বা মুক্ত আছে-এটা মনে করার সুযোগ নেই।’-জুলকারনাইন সায়ের

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম স্বাধীন বা মুক্ত আছে-এটা মনে করার সুযোগ নেই।’-জুলকারনাইন সায়ের

BMTV Desk No Comments

বিএমটিভি নিউজঃ
বর্তমানে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম স্বাধীন বা মুক্ত আছে-এটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। গত ১০ জুলাই ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ ইউটিউব চ্যানেলে সাংবাদিকতায় ‘ভিউ’ এবং ‘ভয়’ শিরোনামে এক টকশোতে এ মন্তব্য করেন তিনি। খালেদ মুহিউদ্দিনের সঞ্চালনায় ওই টকশোতে আরও উপস্থিত ছিলেন টকশো সঞ্চালক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কাজী জেসিন।বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বর্তমানে স্বাধীন মনে হয় কিনা। সংবাদমাধ্যমের মধ্যে কাজ করতে সাংবাদিকদের অসুবিধা হচ্ছে বা কাউকে বেশি খুশি করতে হচ্ছে বলে মনে করেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে জুলকারনাইন সায়ের বলেন, ‘আসলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমে সাংবাদিকরা কীভাবে কাজ করছেন। তাদের ওপর কোনোরকম খড়গহস্ত বা কন্ট্রোল আছে কিনা-এই জিনিসগুলোকে আমাদের অনেকভাবে ভাগ করতে হবে। এখানে একটা সরকার পক্ষ, আরেকটা মালিক পক্ষের চাপ থাকে। বর্তমান সেক্ষেত্রে সেখানে বিভিন্ন পার্টি ইনভলভ আছে। তাদেরকে সেগুলো থেকেও চাপের সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং বর্তমানে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম স্বাধীন বা মুক্ত আছে-এটা মনে করার সুযোগ নেই।’

গত ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আপনি দেখবেন-গত আগস্ট থেকে অনেক রকমের সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। বিশেষ কিছু পত্রিকা, বিশেষ কিছু শিল্পগোষ্ঠী ওন করে থাকে-তারা এমন সব চটকদার কার্যক্রম করেন, যা সাংবাদিকতার মানদণ্ডে আমার মানে হয় না কোনোভাবে উত্তীর্ণ হয়। যেসব মিডিয়া হাউস আছে, তারমধ্যে কিছু এসটাবলিশ করা হয়েছে নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য।’

তিনি বলেন, ‘কিছু চ্যানেল, খবরের কাগজ আছে-যাদের নেপথ্যের ব্যক্তিরা অত্যন্ত বিতর্কিত এবং এদের কাজ হচ্ছে একপক্ষ হয়ে আরেক পক্ষকে আক্রমণ করা, আবার কেউ কেউ আবার সরকারের সহযোগী হয়ে ওঠে। দেখা যায়, যখন সরকার তাদের কথা শুনছে না, তখন তারা সরকারকে আক্রমণ করে। আমার কাছে মনে হয়-এটা বেশ জটিল, মানে দ্য এনভায়রনমেন্ট ইজ ভেরি ডার্টি, বেশ নোংরা একটা এনভায়রনমেন্ট এখানে বিরাজ করছে।’

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ মান যদি ১০০ হয়। এই মহূর্তে শেখ হাসিনা যাওয়ার পর অর্থাৎ ৫ আগস্টের পরে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মানদণ্ডে আপনি কত দিতে চাইবেন-প্রশ্নের জবাবে জুলকারনাইন বলেন, ‘কয়েকটা নিউজপেপার আছে, তারা এখনো কাজ করে যাচ্ছে। সেটা সর্বোচ্চ তিনটার মতো সংবাদমাধ্যম আছে, যারা সঠিক তথ্য দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি বলবো-তাদের স্বাধীনতা ১০০-এর মধ্যে ৪০-এর বেশি নেই। হাসিনার সময় যেটা ২৫ ছিল, সেটা হয়ত এখন ৪০ হয়েছে। অন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নির্ভর করে তাদের মালিক যারা, তাদের মর্জির ওপরে। সুতরাং এটা নিয়ে মন্তব্য করার মতো কিছু নেই আসলে।’

বাংলাদেশের গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রকে আপনি কীভাবে দেখছেন-এই পর্যায়ে এসে? জবাবে কাজী জেসিন বলেন, ‘আপনি বলছেন আগের কথা বাদ, এখন আমরা কেমন আছি, সেটাকে জাজ করার জন্য। আগের কথা বাদ দিয়ে আপনি আজকের বিষয়টা কোনোভাবে জাজ করতে পারবেন না। ভেঙে যাওয়া বাসায় আপনি কেমন করে সাজিয়েছেন, ভুলে যান ভেঙে গেছি কিনা-এ কথাটা আপনি বলতে পারবেন না। আগে কেমন মিডিয়া বা গণমাধ্যম ছিল-সেই প্রশ্নের উত্তরটা আমাদের দেখতে হবে। বিগত ১৫ বছরে যা হয়েছে, সেটা সাংবাদিকতা হয়েছে কিনা। বিরল বা বিকল্প বাদে। গত ১৫ বছর যা হয়েছে, অর্থাৎ এখন শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলতে চায় না, বলে মাফিয়া হাসিনার পতন হয়েছে। মাফিয়া আওয়ামী লীগ বা মাফিয়া হাসিনা যে শাসন ১৫ বছর করেছে, এই শাসনটা যে করতে পেরেছে-এই জায়গাটায় তাদের এনাবেল করেছে তারা। এই মিডিয়াই তাদের সহযোগিতা করেছে পনের বছর শাসন করার জন্য।’

তিনি বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমকে চতুর্থ স্তম্ভ বলি। সেই জায়গা থেকে গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের দর্পণ। সরকার কেমন করছে সেটার দেখার দায়িত্ব হলো গণমাধ্যমের। গণমাধ্যম সেটা দেখায়নি, দেখিয়েছে মানবতার মা শেখ হাসিনাকে। দেখিয়েছে কাঁদো বাঙালি কাঁদো। বাঙালির চোখে পানি নেই। কিন্তু ফোর্স করেছে। সারা মাসজুড়ে শোক করেছে-কাঁদো বাঙালি কাঁদো। তারা কখনো খুন ও গুমের কথা তুলে ধরেনি। এটা আড়াল করার মাধ্যমে মাফিয়াতন্ত্র কায়েমে একরকম সহযোগিতা করেছে গণমাধ্যম।’

গত ১৫ বছর সাংবাদিকতা হয়নি বলে মনে করেন কাজী জেসিন। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছরের সময় বাদ দিয়ে এই সময়টা জাজ করা সম্ভব না। গত ১৫ বছর যেটা হয়েছে, সেটা সাংবাদিকতা ছিল না।’

আপনি (জুলকারনাইন) একজন পেশাদার সংবাদিক। অনুসন্ধান ও সোর্সের মাধ্যমে রাষ্ট্র্রের দুর্নীতি ও অসঙ্গতির অনেক ডকুমেন্ট আপনার হাতে আসে। সেগুলোর কিছু নিজের সোশ্যাল মিডিয়াতেও তুলে ধরেন। আপনার সঙ্গেও সংবাদমাধ্যমের একটা প্রতিযোগিতা আছে। যেটা আপনি প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে ধরছেন না, অনেককিছু ব্যক্তি জায়গা থেকে তুলে ধরছেন। আপনার সঙ্গে আপনিসহ অন্য আর যারা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে সেটার সঙ্গে গণমাধ্যমের কি একটা প্রতিযোগিত হচ্ছে-জবাবে জুলকারনাইন বলেন, ‘আমি যখনই সময় পেয়েছি আল জাজিরা ছাড়া অন্যান্য মাধ্যমেও আমার রিপোর্ট করেছি। নেত্র নিউজের জন্য করেছি। ওসিসিআরপির জন্য করেছি। টাইমসের জন্য করেছি। হারেৎজের জন্য করেছি। এরকম আরো অনেকের জন্য আমি রিপোর্ট করেছি। বাংলাদেশের মানবজমিনের জন্য কয়েকটি রিপোর্ট আমি লিখে দিয়েছি। কিন্তু যেটা হয়, সেটা হলো-আমার কাছে যা আসে এগুলো বাংলাদেশের কোনো পত্রিকা গ্রহণ করতে রাজি হয় না। এখন কেন তারা রাজি হয় না-সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি, অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছে-মালিক ঝামেলা করতে পারে। মালিক পছন্দ করবে না অথবা সরকার চাপ দিতে পারে। নিউজ তুলে নেবে এবং অনেক সমস্যা করতে পারে। আমাদের ওয়েবসাইট হয়ত ডাউন করে দেবে, সাংবাদিককে ভয় দেখাবে।’

বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত অনেকেই ভয় পান। আমার মনে হয় আতঙ্কে থাকেন। আমার অনেক রিপোর্ট হয়ত অনেকের বিপক্ষে গেছে। তাতে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন পত্রিকা বা মিডিয়া হাউজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’

বিগত নির্বাচনে গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে জুলকারনাইন সায়ের বলেন, ‘২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচন হয়েছে। সে সময় গণমাধ্যমগুলো কতটা স্ট্রং ভূমিকা রেখেছিল? সেটা কিন্তু আমরা দেখিনি। কিন্তু যখন একটা আওয়াজ তুলেছে, সামনে চলে এসেছে তাও আমাদের মতো যারা দেশে বাইরে ছিল তাদের হাত ধরে। তখন জিনিসটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা সহজ হয়ে গেছে, বিকজ সামবডি হ্যাস ব্রট ইট টু দ্য লাইট। বাট ডেলিবারেটলি নিজের থেকে যেমন ধরেন এস আলমের কাণ্ড হলো। এস আলমের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক দখল করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করে। এটা প্রথমে রিপোর্ট করেছে দ্য ইকোনমিস্ট। এরপর দেশের কয়েকটা পত্রিকা চেষ্টা করেছে। কিছু জায়গা থেকে নিউজটা নামিয়ে নেয়া হয়েছে।’

এই প্রবাসী সাংবাদিক বলেন, ‘বিএনপির সালাউদ্দিন সাহেব। উনাকে দেশের একটি সংস্থা, যেমন র‍্যাব পিক করে বর্ডারের অপর সাইডে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসছে। একটা পত্রিকা নিউ এজ ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ও সাংবাদিক মুক্তাদির ছাড়া কেউ এত এক্সটেন্সিভ রিপোর্ট করতে পারেনি। ডেভিড বার্গম্যানের পক্ষেও বাংলাদেশে থাকা সম্ভব হয়নি। সাংবাদিক মুক্তাদির রশিদকেও বিভিন্ন জায়গা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। সবাই আসলে সঠিক কাজটা করেনি।’

নতুন যে সাংবাদিক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এই দশ মাসে যারা সাংবাদিকতা করছেন-তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই প্রভু বদলিয়েছে, অবস্থান বদলায়নি। তারা কেউ কেউ দাবি করছে-আমরা বিএনপির ঘনিষ্ঠ লোক, সেজন্য আমি এখন সম্পাদক হবো। আমি জামায়াত বা এনসিপির লোক এজন্য সম্পাদক হবো। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যা করেছে সেটা করা বর্তমানে ঠিক হবে কিনা, জবাবে জুলকারনাইন বলেন, ‘না এটা একেবারেই ঠিক হবে না। এই জিনিসটই বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে সাংবাদিকতার পেশায় প্রিফারেন্স দেয়া হয়, এটা বন্ধ করতে হবে। যে ব্যক্তি নিজের স্বাধীনতা, ইন্টিগ্রিটি এবং সততা বজায় রেখে এই পেশার মানটা ধরে রাখতে পারবে তাদেরকে বিবেচনায় নেয়া উচিত। কে কোন মতের, কোন দলের এই রকম কখনোই করা উচিত না।’

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে জুলকারনাইন বলেন, ‘১৮ কোটি মানুষের মধ্যে হাতে গোনা ২০ থেকে ২৫ জন সাংবাদিক যারা গত ১৫ বছরে সঠিক কাজটা করেছে। দেশে থেকে হোক, দেশের বাইরে থেকে হোক।’

তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার সাংবাদিক রেজিট্রার্ড আছে, ডিআরইউসহ কমপক্ষে একশটার মতো ইউনিয়ন আছে তারা কী কাজটা করছে?’

দেশের বর্তমান সাংবাদিকতা নিয়ে কাজী জেসিনের কাছে প্রশ্ন রাখেন উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দিন। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়-মূল জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ঢেলে সাজানো ছাড়া, যাই হবে সুপারফেসিয়াল, ওপর থেকে একজন ব্যক্তি পরিবর্তন হলে, দুইজন ব্যক্তি পরিবর্তন হলে তো হবে না। পুরো সিস্টেমটাই তো করাপ্ট। এখানো কর্পোরেট সেন্সরশিপ আছে, পলিটিক্যাল সেন্সরশিপ তো আছেই। যখন কালো টাকার বিনিয়োগ থাকবে তখন পলিটিক্যাল সেন্সরশিপ আসবে। শেখ হাসিনা কিন্তু নব্য বাকশাল, ডিজিটাল বাকশাল কয়েম করেছেন। কীভাবে! পত্রিকা বন্ধ না করে, আরও বেশি বেশি লাইসেন্স দিয়ে সবগুলোকে নিজের মাইক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স দেয়া হয়েছে নিজেদের লোককে। যারা তার বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী বা যাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। কিংবা মন্ত্রীর ভাই তাদেরকে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তাদের কাছে এই চ্যানেলগুলো আছে। এই চ্যানেলগুলো থেকে আপনি কী আশা করবেন?’

সুত্র দৈনিক মানবজমিন