You must need to login..!
Description
ঃ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ঃ
কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে আজ বদলে যাচ্ছে পৃথিবী, মানুষের জীবন-যাপন, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এমনকি সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এ প্রেক্ষিতে আজ সময় এসেছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবার,কথা বলার।করোনা মহামারীতে সবদেশই তাদের নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ দেখতে পেয়েছে। যারা নিজেদেরকে শক্তিশালী মনে করতো তারাও আজকে অসহায়। আর তাই সবার নজর এখন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর দিকে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম পণ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ঢেলে সাজিয়েছিলেন স্বাস্থ্যব্যবস্থা। চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ও ইন- সার্ভিস ট্রেনিং প্রথা চালুর মাধ্যমে চাকুরির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন সাবসেন্টার, নিপসম, বিএমআরসি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ সহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরো অনেক কিছু। পরবর্তী
সময়ে আমরা চিকিৎসক সমাজ একুশ বছর ২১ দফা, ২৩ দফা নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। নব্বয়ের গণ অভ্যূত্থানে ডা. মিলন-এর শহীদ হওয়ার পর আমরা আশা করেছিলাম পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার চিকিৎসকসহ সকল পেশাজীবির দাবী-দাওয়া পূরণ
করবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর আমাদের আরো অনেক উন্নয়ন লক্ষ্য করেছি। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, কমিউনিটি ক্লিনিক, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত হাসপাতাল সহ অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০১ সালের পর কমিউনিটি বন্ধ করে দেয়া হয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্জনগুলো পিছিয়ে পড়ে। আবার ২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর স্বাস্থ্যসেক্টরে আবারও উন্নয়নের গতি ফিরে পেলো। প্রতিষ্ঠা হতে লাগলো আরো বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, আবারো চালু হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। আন্তর্জিতিক অনেক সূচকেও এগিয়ে গেলো স্বাস্থ্যখাত। যার ফলশ্রুতিতে ২ Millenium Development Goal অর্জনে সাউথ-সাউথ সহ নানা’ পুরস্কারে ভূষিত হন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
গত এক যুগে স্বাস্থ্যখাতে যে উন্নয়ন হয়েছে তার ফলেই কোভিড-১৯ মহামারীতেও মোকাবিলা করে যাচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। স্বল্প সময়েও অনেক উন্নত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেখানে ভেঙ্গে পড়েছে সেখানে আমরা গত পাঁচ মাস ধরে আমাদের বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে সফলতার সাথে কোভিড-১৯ মোকাবেলা করে যাচ্ছি। এর মধ্যেও অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও অনাকাংখিত দুর্নীতির জন্ম হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে।জনগণের প্রত্যাশাও আকাশচুম্বী, আর এখনই সময় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর।
আমাদের দেশের প্রাইমারী হেলথ কেয়ার সেই গুটিবসন্ত, কলেরা/ডায়েরিয়া, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থ্যা জনগণের আরো দোরগোড়ায় পৌছে দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের মাধ্যমে। প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবায় জননেত্রী শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক আজ সারা বিশ্বে নন্দিত ও প্রশংসনীয়। আমাদের দেশে এখন শহরান্চলে প্রাইমারী হেলথ কেয়ার-কে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আজকের বাস্তবতায় এমন এক স্বাস্থ্যব্যবস্থ্যা দরকার যা মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করবে। সেজন্য-
• কমিউনিটি ক্লিনিক-কে আরো শক্তিশালী করতে কমিউনিটি ক্লিনিকে Maternal and Child Health Service দ্রুত বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
• উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদ মর্যাদা উন্নিত করা যেতে পারে।
• উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ইমারজেন্সি মেডিক্যাল অফিসার (ইএমও), মেডিক্যাল অফিসার এবং ডেন্টাল সার্জন এর পদ সৃষ্টি করে বহির্বিভাগ সেবাকে আরে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
• উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ২৪ ঘন্টা Maternal and Child Health Service চালু করা যেতে পারে।
• জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন এর পদ মর্যাদা উন্নিত করতে হবে সেই সাথে কমপক্ষে ৩ টি অতিরিক্ত সিভিল সার্জন এর পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে(অতিরিক্ত সিভিল সার্জন- প্রাইমারী হেলথ কেয়ার, অতিরিক্ত সিভিল সার্জন -প্রশাসন, অতিরিক্ত সিভিল সার্জন- স্বাস্থ্য সেবা)।
• জেলা সদর হাসপাতালগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে জেলার স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত করতে হবে এবং নতুন পদ সৃষ্টি করে জনবল বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
• জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে ইমারজেন্সি মেডিক্যাল অফিসার (ইএমও), মেডিক্যাল অফিসার, ডেন্টাল সার্জন সহ জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সকল বিভাগে স্পেশালিস্ট পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
• জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ আইসিইউ, সিসিইউ, অপারেশন থিয়েটার এর সাথে সিটি-এমআরআই সহ সকল ধরনের প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
• টারশিয়ারী এবং স্পেশালাইজড হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে ও আমাদের মতো জনবহুল একটি দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নতুন পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
• স্বাস্থ্যসেবা কে যুগোপযোগী, সু-শৃঙ্খল ও কার্যকরী সেবা প্রদানের লক্ষ্যে উন্নত দেশের ন্যায় রেফারেল সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।
• বিভাগীয় পরিচালকের পদমর্যাদা উন্নীত করতে হবে এবং উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
• মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক ও অধ্যাপক- এর পদ মর্যাদা উন্নতি করা যেতে পারে।
• দেশে স্বাস্থ্য সেক্টরের কাজকে গতিশীল করতে একটি Health Trainings Institute স্থাপন জরুরী যা অতি দ্রুত করা যেতে পারে।
মন্ত্রণালয়ে চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে এবং আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈষম্য দূর করা যেতে পারে।
•স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সকল অধিদপ্তরসমুহকে একই ভবনে এনে স্বাস্থ্যখাতে প্রশাসনিক ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ প্রবর্তন করা গেলে তা হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
• বিসিএস-এ বিদ্যমান ১টি ক্যাডারকে নিম্ন লিখিত চারটি স্তরে সাজাতে হবে, যেমন:
১) বিসিএস স্বাস্থ্য প্রশাসন।
২) বিসিএস স্বাস্থ্য শিক্ষা।
৩) বিসিএস স্বাস্থ্য সেবা।
৪) বিসিএস স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা।
এবং সব ক্যাডারের ডিজি কে গ্রেড-১ পদমর্যাদা দেয়া যেতে পারে।
• বিসিএস লিখিত পরীক্ষাকে যুগোপযোগী করতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র সিলেবাস প্রণয়ন করা যেতে পারে।
• আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে ও অপচয় রোধ করে দ্রুত, সঠিক ও প্রয়োজনমাফিক কেনাকাটার জন্য সমস্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সায়ত্বশাসন প্রদান করা যেতে পারে।
• চিকিৎসাসেবা জনগণের জন্য সহজলভ্য ও নিশ্চিত করতে দেশে ক্রমান্বয়ে হেলথ ইন্সুরেন্স চালু করা যেতে পারে।
• পরিবার-পরিকল্পনা সব দেশেই Maternal and Child Health (MCH) ভিত্তিক সেবা এবং এই সেবায় চিকিৎসকের বিকল্প চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই। কাজেই চিকিৎসকদের প্রাধান্য দিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং মন্ত্রণালয়কে সেভাবে বিন্যস্ত করা যেতে পারে।
• বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
• জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করে। বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তর প্রয়োজন।
• দেশে একটি ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে।
• স্বাস্থ্য প্রশাসন এর বিভিন্ন স্তরে ডেন্টাল সার্জন এর পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
• হাসপাতালগুলোর ঔষধ বিতরণ ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল ও কার্যকরী করতে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিএসসি-ফার্মাসিস্ট এর পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
• দেশের ঔষধ শিল্প ও বিভিন্ন ফার্মেসীর কথা চিন্তা করে ঔষধ প্রশাসনে নতুন পদ সৃষ্টি করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
• নার্সিং অধিদপ্তরে পেশাদারি নার্সিং কর্মকর্তা পদ সৃষ্টি করে নার্সিং অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে।
• হোমিওপ্যাথি ও আয়ূর্বেদী -কে আরো যুগোপযোগী করতে হবে। ইতিমধ্যে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে পদায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
• স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজিয়ে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
• স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কাজ করানো হয়। তাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ব্যয় অধিক হয় এবং সময়ও অধিক লাগে। সেই সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে কোন জবাবদিহিতা থাকে না। কাজেই, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ণ স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকেই করতে হবে।
• স্বাস্থ্যখাতে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বাজেট বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এবার স্বাস্থ্যখাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মানী বাবদ ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেন্জ হলো দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব, দক্ষ জনবলের অভাব, লাল ফিতার দৌরাত্ম এবং দুর্নীতির সিন্ডিকেট।এক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে বাজেটের যথাযথ ব্যবহারের
সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।। সঠিক বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই।
কোভিড-১৯ জণগণের দৃষ্টিচক্ষু উন্মোচন করে দিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য সেক্টর সহ দেশের সকল উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হয়েছে। আমাদের চিকিৎসকদের প্রত্যাশা, সময়ের দাবী, জনগণের দাবী, বিগত দিনের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি গণমুখি
স্বাস্থ্যব্যবস্থা, কোভিডোত্তর বাংলাদেশ এটাই প্রত্যাশা করে।
অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ
মহাসচিব স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বাংলাদেশে