করোনাকালে সচেতনতা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা – স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ

image

You must need to login..!

Description

 

কোভিড-১৯ প্রথম সনাক্তকরণের পর ইতোমধ্যে ছয় মাস পেরিয়েছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ছয় লাখের অধিক।করোনা সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এটি অনুধাবন করা যায় যে করোনার তান্ডব সহসাই থামছে না। করোনার প্রভাবে প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষের জীবন-যাপন, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণ সহ বিশ্বের সর্বক্ষেত্রেই আজ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা মেনে চলার ব্যাপারে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনের ন্যায় কিছু শব্দের প্রচলন হয়েছে যা অনেকের কাছেই নতুন।চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক দুর্বোধ্য শব্দ সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা ছাড়াই সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। দুর্বোধ্য ও অপরিচিত এই শব্দগুলো সাধারণ মানুষের কাছে সহজতর ও বোধগম্য করা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দশ্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

কোভিড-১৯ :
কোভিড-১৯ হলো সংক্রামক ব্যাধি অর্থাৎ ছোঁয়াচে রোগ যার জন্য দায়ী হলো একটি আবরণীবদ্ধ আরএনএ ভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ দিকে চায়নার উহানে ‘নিউমোনিয়া (শ্বাসতন্ত্রের রোগ)’ রোগ ধরা পড়ে যার কারণ ছিল অজানা, পরে এর কারণ হিসেবে দেখা যায় যে করোনাভাইরাসের নতুন একটি প্রজাতি (SARS-CoV-2) এর জন্য দায়ী এবং এর পর থেকে ‘২০১৯-নোভেল করোনা ভাইরাস’ নামে অভিহিত করা হয়। পরবর্তিতে ২০২০ সালে ১১ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা কর্তৃক “কোভিড-১৯ নামে নামকরণ করা হয়।

ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা):
ইমিউনিটি হল মানবদেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার গুণমান বা অবস্থাকে ইমিউনিটি বলা হয়। বিশেষত: কোন প্যাথোজেনিক অনুজীবের বিকাশ রোধ করার মাধ্যমে বা এর উৎপাদিত বস্তুসমূহের প্রভাবগুলো প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি বিশেষ রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হওয়ার অবস্থাই শরীরের ইমিউনিটি হিসেবে বিবেচিত হয়।

হার্ড ইম্যুনিটি:
একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার ৬০ হতে ৮০ শতাংশ জনগণের মাঝে যদি কোন সংক্রামক রোগ এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তখন সেই জনসংখ্যার যেসকল লোকের মাঝে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়নি তাদের মাঝে রোগ সংক্রামণ বাধাগ্রস্থ হয়; একে ‘হার্ড ইম্যুনিটি’ বলে। দেহে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভ্যাকসিন এর মাধ্যমে বা সেই রোগদ্বারা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তৈরি হতে পারে।

সামাজিক দূরত্ব :
কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে অন্যান্য সুরক্ষা ব্যাবস্থার সাথে নিজের বাড়ির বাইরের মানুষের সাথে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় ৬ ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একেই সামাজিক দূরত্বও বলে।

হ্যান্ড সেনিটাইজার :
একধরনের তরল জীবাণু নাশক যা হাত বা শরীর এর সংস্পর্শে আসা জীবানুকে মেরে ফেলতে পারে।

এনডেমিক :
একটি রোগ বা ব্যাধি যা একটি নির্দিষ্ট লোকালয় বা জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রতিনিয়ত কমবেশি বর্তমান থাকে তাকে এনডেমিক বলে। যেমন: পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি ম্যালেরিয়ার জন্য এনডেমিক জোন।

পেনডেমিক (মহামারি):
সমগ্র দেশ বা মহাদেশ বা বিশ্বব্যাপী কোন রোগ বা ব্যাধীর প্রাদুর্ভাব।

সার্ভিলেন্স (সন্দেহভাজন মানুষ এর উপর কড়া নজর রাখা):
যে সমস্ত কারন কোনো ব্যাক্তির অসুস্থতার জন্য দায়ী সে সমস্ত কারন, উপাদান বা ঘটনাকে সার্বক্ষনিক নিরীক্ষন করাকে সার্ভিলেন্স বলে।

সেরোলজীসার্ভিলেন্স:
রক্তের সিরামে কোন এ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করাকে সেরোলজী বলা হয়। একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার মাঝে কোন রোগের প্রাদুর্ভাব বা সংক্রমণের ব্যাপ্তি দেখার জন্য সেরোলজী সার্ভিলেন্স করা হয়।

কন্টাক্ট ট্রেসিং (যোগাযোগ অনুসন্ধান করা):
এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রোগাক্রান্ত ব্যাক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যাক্তিকে সনাক্তকরন, যাচাইকরন এবং নিয়ন্ত্রন করা হয় যাতে পরবর্তী সংক্রমন প্রতিরোধ করা যায়।

আইসোলেশন (পৃথকীকরন):
এটি সংক্রামক রোগের বিস্তার বন্ধ করার জন্য সর্ব প্রাচীন পদ্ধতি। সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে অন্যদের থেকে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আলাদা রাখা হয় যেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যদের মধ্যে রোগ বিস্তার করতে না পারে।

কোয়ারেন্টাইনঃ
সংক্রামক রোগের বিস্তার বন্ধ করার জন্য কোনো সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্য সুস্থ মানুষ (যারা সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসে নাই) থেকে আলাদা রাখাকে কোয়ারেন্টাইন বলে । কোয়ারেন্টাইন এর সময়কাল জীবানুর উন্মেষকাল এর সমান হয়।

হোম কোয়ারেন্টাইনঃ
সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষকে নিজের বাড়ীতে একটি রুমে অন্যদের থেকে আলাদা রাখাকে হোম কোয়ারেন্টাইন বলে ।

প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনঃ
সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষকে কোনো প্রতিষ্ঠান এর তত্বাবধানে অন্যদের থেকে আলাদা রাখাকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বলে।

লকডাউনঃ
সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধের জন্য জনসাধারণকে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অত্যাবশকীয় প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে না বের হওয়াকে লকডাউন বলে।

জোনিং: নির্দিষ্ট এলাকায় সংক্রমণের হার ভিন্নতায় এলাকাসমূহ সবুজ, হলুদ এবং লাল -এভাবে চিহ্নিত করাকে জোনিং বলা হয়।
সবুজ এলাকা (গ্রীণ জোন) হলো কোন নির্দিষ্ট এলাকাতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মাঝে যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তিন জনের নীচে থাকে।

হলুদ এলাকা (ইয়েলো জোন) হলো কোন নির্দিষ্ট এলাকাতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মাঝে যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩-৫৯ জন হয়ে থাকে।

লাল এলাকা (রেড জোন): কোন নির্দিষ্ট এলাকাতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মাঝে যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ জন বা তা চেয়ে বেশী থাকে।

ট্রায়াজ (পৃথকীকরন):
হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ ও নন কোভিড-১৯ রোগীদের পৃথকিকরণ করে চিকিৎসা প্রদান করা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ট্রায়াজ বলতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিৎসার ব্যাবস্থাকে বুঝায়।

আরটি-পিসিআর (রিভার্স টান্সক্রিপশন রিয়েল টাইম পলিমারেস চেইন রিঅ্যাকশন):
আরটি-পিসিআর হচ্ছে নভেল করোনা ভাইরাসের জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক অদ্যবদি একমাত্র স্বীকৃত, নির্ভরশীল এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা পদ্ধতি। ব্যক্তির কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নমুনা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় কেবল আরএনএ বের করা হয়। তারপর এক্সট্রাক্ট আরএনএকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার করে কম্পলিমেন্টারী ডিএনএতে রূপান্তর করা হয় এবং পলিমারেজ চেইন রিএকশন (পিসিআর) ব্যবহার করে প্রাপ্ত ডিএনএর একটি অংশকে পরীক্ষা করে এটি SARS-CoV-2 এর জেনেটিক কোড এর সাথে মিলয়ে দেখা হয়।

পিপিই (ব্যাক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী):
পিপিই এর মধ্যে রয়েছে চশমা/ফেসশিল্ড, মাস্ক (মুখ বেষ্টনী), ক্যাপ, গাউন (কভার অল, সার্জিকেল গাউন, গ্লভস, সু-কাভার যা চিকিৎসকগণ রোগীর চিকিৎসা প্রদানের সময় ব্যবহার করে থাকেন। তবে সাধারণ জনগণের জন্য করোনা প্রতিরোধে ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।

অক্সিজেন থেরাপি:
রোগীর শ্বাসকষ্ট হলে বা শরীরে অক্সিজেনের পরিমান কমে গেলে হাসপাতাল সমূহে চিকিৎসকের পরামর্শে নিম্নের যেকোন পদ্ধতি অবলম্বনে অক্সিজেন থেরাপী দেয়া হয়-

* অক্সিজেন সিলিন্ডার : অক্সিজেনকে অত্যাধিক প্রেশার এ তরল করে সরবরাহ করা হয় যা দিয়ে প্রতি মিনিটে ২-১৫ লিটার অক্সিজেন দেয়া যায়।

* হাই ফ্লো নেজাল ক্যানুলা: এই যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চ চাপে নেজাল কেনুলার সাহায্যে রোগীকে প্রতিমিনিটে ৭০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। বর্তমান বিশ্বে কোভিড ১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে।

* অক্সিজেন কনসেনট্রেটর: এটি একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র যার সাহায্যে বাতাস থেকে অক্সিজেনকে ঘন করে রোগীকে সরবরাহ করা হয়, ফলে রোগীকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে দীর্ঘসময় ১-১০লি. পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।

নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর:
বাইপেপ (Bi-PEP): বাই পেপ মেশিনের সাহায্যে যাদের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)আছে যা ফুসফুসের একধরনের জটিল রোগ তাদের প্রতি মিনিটে ১৫০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেয়া যেতে পারে।
সি-পেপ: সি-পেপ মেশিনের সাহায্যেও প্রতি মিনিটে ১০০-১৫০ লিটার অক্সিজেন দেয়া যায়।

* লাইফ সাপোর্ট / মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর:
এই যন্ত্রের সাহায্যে রোগীর সম্পূর্ন শ্বাস-নিঃশ্বাস মেশিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করে বাঁচিয়ে রাখা হয়।

আইইডিস্আির (রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষনা ইনষ্টিটিউট):
আইইডিসিআর হল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ সরকারের একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট যা বাংলাদেশে মহামারী ও সংক্রামক ব্যাধি গবেষণা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয় নিয়ে কাজ করে।

মহামারী প্রতিরোধে মাননীয় প্রাধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ৩১ দফা নির্দেশনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের ১২ দফা স্বাস্থ্যবিধির প্রস্তাবনার সুফল আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের ন্যায় ডিজিটাল বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন এর জনপ্রিয়তা সাধারণ মানুষের মাঝে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সুফল পাচ্ছেন। সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিই হবে সংকট উত্তোরণের পথ। সঠিক তথ্য সহজ করে তুলে ধরার মাধ্যমে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে এবং জনসাধারনকে দৈনন্দিন কর্মকান্ডে, অফিস- আদালতে স্বাস্থ্যবিধি সমূহ (যেমন ২০ সেকেন্ড ধরে বার বার হাত ধৌত করা, মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে ,তবেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে, আমরাও ফিরে আসবো সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে।

প্রধান সম্পাদকঃ
মতিউল আলম

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ
মাকসুদা আক্তার