কোভিড-১৯ প্রতিরোধে মাস্ক ও কিছু গুরুত্বপুর্ণ তথ্য

image

You must need to login..!

Description

 

অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ঃ তড়িৎগতিতে এগিয়ে চলা বিশ্বকে হঠাৎ থমকে দিয়েছে কোভিড-১৯ যা মহামারী আকারে অতিদ্রুত সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মহামারীকে প্রতিরোধ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর্মীসহ বিশ্বের সকল মানুষ মাস্ক ব্যাবহার করছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন কারনেই বর্তমানে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে -মাস্ক।‘মাস্ক’ হলো মুখ বেষ্টনি। এ সময়ে সারা বিশ্বে মাস্ক একটি অতি পরিচিত ও জনস্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ন উপাদান। পৃথিবীতে মাস্ক পরা কবে কখন শুরু হয়েছিল তার প্রকৃত তথ্য সঠিক ভাবে কারো জানা নেই, তবে প্রচীনকাল থেকেই মানুষ এই মুখবেষ্ঠনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে ব্যাবহার করে আসছে। আর্ট—কালচার, ধর্মীয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে শুরু করে অপরাধ জগতেও এর ব্যাবহার রয়েছে। ইতিহাসে পাথরের তৈরী মাস্ক এর কথাও উল্লেখ আছে।

এই মহামরী চলাকালীন সময়ে মাস্ক এর প্রস্ততকারক যেমন মাস্ক নিয়ে ব্যবসা করছে, মাস্ক এর মান নিয়েও সমালোচনা চলছে, কিছুক্ষেত্রে দুর্নীতির চিত্রও উঠে এসেছে। একই সাথে মাস্ক নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণাও চলছে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের মাস্ক দেখা যায়। ফেশন ডিজাইনার বিভিন্ন ধরনের মাস্ক তৈরী করছে এবং জনগনকে আকৃষ্টও করছে। অনেক দেশে রাজনীতিবিদরা মাস্ককে দলীয় প্রতীক হিসেবে ব্যাবহার করে মাস্ককে আরও জনপ্রিয় করে তুলছে। যাই হোক আমরা আজ মাস্ক এর ধরন, মাস্ক কেন পড়বেন, মাস্ক পড়ার নিয়ম ও মাস্ক কখন বদলাতে হবে তা সহ নানাবিধ আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যা মহামারীতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে বলে আশা করি।

ফেস মাস্ক এর ধরনঃ আমাদের দেশে তিন ধরনের মাস্ক এর প্রচলন আছে-
১. কাপড় এর মাস্ক,
২. সার্জিক্যাল মাস্ক, ও
৩. এন ৯৫ মাস্ক।

কাপড়ের মাস্ক: কয়েক প্রস্থ কাপড়ের মাস্ক ৯৬% পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে, তবে এটি নির্ভর করে কাপড়ের ধরন ও প্রতি ইঞ্চিতে বুনন সংখ্যার উপর। সুতি কাপড় থেকে পলিস্টার কাপড়ের ইলেক্ট্রোস্টেটিক শোষন ক্ষমতা বেশি।
সাধারন সার্জিক্যাল মাস্ক: সার্জিক্যাল মাস্ক-এ আকৃতি নিয়ন্ত্রক ছাড়া বাকি তিনটি আবরন থাকে, ফলে শক্তভাবে না আটকানোর জন্য এটি বাতাসকে সম্পূর্ন পরিষ্কার করতে পারে না। (চিত্র নিচে দেয়া হল)

এন ৯৫ মাস্ক এর গঠন: এন দিয়ে বুঝায় এটি তৈল নিরোধক নয়। এর চারটি আস্তরন থাকে, ভিতর থেকে বাহিরে যথাক্রমে নরম আবরন, আকৃতি নিয়ন্ত্রক, ফিল্টার, তরল নিরোধক আবরন। এখানে ফিল্টার হিসেবে মেল্ট ব্লোউন ফাইবার ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা ০.৩ মাইক্রন সাইজ এর ৯৫% জীবানু ও ধুলিকনা ছেকে নিতে সক্ষম। আমরা জানি করোনা ভাইরাস এর সাইজ ০.০৬ থেকে ০.১৪ মইক্রন, তাহলে এন ৯৫ মাস্ক কিভাবে জীবানু থেকে আমাদের বাচাবে? এন ৯৫ মাস্ক এর মেল্ট ব্লোউন ফাইবার ছোট কনাকে আরও ভাল ভাবে আটকায় — অতি সুক্ষ কনার ব্রাউনিয়ান মুভমেন্ট ও এর ইলেক্ট্রোস্টেটিক শোষন ক্ষমতার মাধ্যমে। বারবার ব্যবহার ও মজুদ করে রাখার কারনে ইলেক্ট্রোস্টেটিক শোষন ক্ষমতা কমে যায় তাই এটি পুনরায় ব্যাবহার না করাই ভাল তবে যে ধরনের মাস্কই ব্যাবহার করা হোক না কেন মুখের সাথে বায়ু নিরোধক হয়ে লেগে না থাকলে এর কার্যকারীতা ৬০% এর ও নিচে নেমে যায়। (নিচে বিভিন্ন মাস্ক এর তুলনা দেয়া হল)

কেন মাস্ক পড়বেন ?
আমরা কথা বলার সময় কয়েক হাজার (১০০০—১০,০০০) পানি কনা বাতাসের সাথে ভেসে বেড়ায়, গবেষকরা দেখেছেন বদ্ধ রুমের জানালা দিয়ে এই কনাদের (<৪মাইক্রন) বের হতে ১৪ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগে। কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে মুখ থেকে বের হওয়া এই সুক্ষ কনায় ভাইরাস এর পরিমান প্রায় ৭ লক্ষ (সর্বোচ্চ ২৩.৫ কোটি)। অর্থাৎ কোভিড-১৯ এ বাতাসস্থ জীবানু থেকে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা জানি করোনা প্রতিরোধে সার্জিক্যাল মাস্ক কাপড়ের মাস্ক থেকে ৩ গুন বেশি কার্যকর। বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচার গত ৩রা এপ্রিল’২০ এক প্রবন্ধে উল্লেখ করে সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক অসুস্থ মানুষ থেকে করোনা ভাইরাস এর সংক্রমন রোধ করতে পারে। ভেন ডার সেন্ডি ও তার দল গবেষনায় দেখেছেন যে কোন মাস্ক পড়লে সংক্রমন ঝুকি কমে যায়। তাছাড়া ও আমরা জানি ১০মাইক্রন কনায় ভাইরাস থাকার সম্ভাবনা থাকে মাত্র ০.৩৭%। অর্থাৎ হাসপাতালের আইসিইউ এর বাইরে খোলা জায়গায় কেউ যদি কয়েকপ্রস্থ কাপড় এর মাস্ক ব্যাবহার করে সেই সাথে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলেই সে নিজেকে সংক্রমন মুক্ত রাখতে পারবে। সামগ্রিক ভাবে এর সুফল পেতে হলে আমাদের সকলকেই ফেস মাস্ক ব্যাবহার করতে হবে। বিগত ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির সময় গবেষকরা দেখেছেন ৫০% জনগন যে কোন ফেস মাস্ক ব্যাবহার করলে সমষ্টিগতভাবে ৫০% ব্যাপকতা ও ২০% নতুন সংক্রমন কমে গিয়েছিল এবং যখন ৮০% জনগন ফেস মাস্ক ব্যাবহার করে তখনই ইনফ্লুয়েঞ্জা নির্মুল হয়েছিল।

মাস্ক পড়ার নিয়ম:

মাস্ক পরার আগে ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাস্কটি এমনভাবে পড়তে হবে যেন তা সম্পূর্ণভাবে নাক ও মুখ ঢেকে রাখে এবং মুখ ও মাস্কের মাঝে কোনো ফাঁকা না থাকে। মাস্ক পরিহিত অবস্থাতে যদি নি:শ্বাস ছাড়ার পর ফেসশিল্ড/চশমা ঘোলা হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে মাস্কটি সঠিকভাবে পড়া হয়নি, মুখ ও মাসকের মাঝখানে ফাঁকা রয়েছে। মাস্কটি পরিহিত অবস্থায় মাস্কের মূলঅংশে হাত দিয়ে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং মাস্ক খোলার সময় দুই পাশের ফিতা ধরে খুলতে হবে। কোনঅবস্থাতেই মাস্কটি নাক ও মুখ থেকে নিচে নামিয়ে রাখবেন না।
কখন মাস্ক বদলাবেন:

নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাস্ক বদল করতে হবে! একটি মাস্ক সাধারণত ৬ ঘন্টা ব্যবহার করা যায়। পরিহিত মাস্ক কোন কারনে লালার সংস্পর্শে আসলে, ভিজে গেলে, নষ্ট হলে, ভালোভাবে মুখে না আটকালে, শ্বাস নিতে কষ্ট হলে মাস্ক বদল করতে হবে। মাস্ক বদলের পূর্বে এবং পরে হাত পরিস্কার করে ধুয়ে নিতে হবে এবং ব্যবহৃত মাস্কটি যত্রতত্র না ফেলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। কাপড়ের মাস্ক ভালোমতো সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার যায়। সার্জিক্যাল মাস্ক সাধারণত একবার ব্যবহারযোগ্য, আর একটি এন৯৫ মাস্ক একবার ব্যবহারের পর পরিস্কার এয়ারটাইট পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষণ করে ৫ দিন পর পর সর্বোচ্চ ৫ বার পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিক নিয়মে মান সম্মত মাস্ক পড়তে হবে। আইসিইউ ও কোভিড ওয়ার্ডে অবশ্যই পিপিই সহ এন৯৫ বা সমমানের মাস্ক পড়তে হবে। অন্যান্য ননকোভিড হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যখাত এর অন্যান্য কর্মীদের সার্জিক্যাল মাস্ক পড়তে হবে, এবং সাধারন জনগন কয়েকপ্রস্থের কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করবে। মাননীয় প্রধনমন্ত্রী ৩১দফা স্বাস্থ্য নির্দেশনা সর্বমহলেই প্রশংসিত হয়েছে। জনগন স্বাস্থ্যবীধি মেনে চললে আমাদের দেশের সংক্রমন আরও কমে আসবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মাস্ক পড়তে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারনা শুরু করেছে। আমার বিশ্বাস এই সমস্ত প্রচার প্রচারনার মাধ্যমে সমাজ এর সব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে করোনা প্রতিরোধে আমরা একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারব। পৃথিবীর সব দেশের মতই জীবন ও জীবিকার স্বার্থে মহামারী প্রতিরোধে একমাত্র উপায় হল স্বাস্থ্যবীধি মেনে চলা। সকলের মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘনঘন হাত ধোয়া মহামারী প্রতিরোধে একমাত্র অস্ত্র। কাপড়ের মাস্ক সকল শ্রেনি পেশার মানুষের কাছে সহজলভ্য। আসুন সবাই মাস্ক পড়ি, স্বাস্থ্যবীধি মেনে চলি, তাহলেই এই মহামারী নিয়ন্ত্রনে সফলতা আসবে আর আমরা ফিরে পাবো কোভিডোত্তর সুন্দর পৃথিবী।
লেখক অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ, মহাসচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)

প্রধান সম্পাদকঃ
মতিউল আলম

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ
মাকসুদা আক্তার