চালের কত অংশ ছাঁটাই করা যাবে তা বেঁধে দিতে যাচ্ছে সরকার

image

You must need to login..!

Description

বিএমটিভি নিউজ ডেস্কঃ চাহিদার কারণে চাল অতিরিক্ত ছাঁটাই ও পলিশ করে চিকন বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে চালের পুষ্টিগুণ। এই প্রেক্ষাপটে চালের কত অংশ ছাঁটাই করা যাবে তা বেঁধে দিতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য একটি নীতিমালা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।‘মিনিকেট’ ও ‘নাজিরশাইল’ নামে কোনো ধানের জাত নেই। ‘মিনিকেট’ ও ‘নাজিরশাইল’ বানাতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করা হচ্ছে। এসব চাল খেয়ে পুষ্টিবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব খাজা আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ছাঁটাই নীতিমালার খসড়া প্রণয়নে কাজ করছে। কৃষিবিজ্ঞানীসহ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাল ছাঁটাই ও পলিশ করে ‘মিনিকেট’ এবং ‘নাজিরশাইল’ করা হয়। ১০ শতাংশের বেশি চাল ছাঁটাই করা উচিত নয় বলেও জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।

একই সঙ্গে চালের বস্তায় ধানের জাতের নাম লেখা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টিও ভাবছে সরকার। এ বিষয়টি ছাঁটাই নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ‘আমরা চাল ছাঁটাই নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছি। অন্য দেশে ছাঁটাই নীতিমালা আছে কি না কিংবা তারা কতটুকু চাল ছাঁটাই করে, তা দেখা হচ্ছে। ব্রিসহ (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। যেটা লজিক্যাল, তারা সেটা করবেন।’নীতিমালা করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খাজা আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘কমিটিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তরের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। যারা ধান নিয়ে কাজ করেন এমন এক্সপার্টরাও রয়েছেন কমিটিতে।’

তিনি বলেন, ‘ধান বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৮ শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করলে চালের পুষ্টি উপাদান থাকবে। বেশি করলেই পুষ্টি কমে যাবে। আমরা দেখেছি ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল বেশি দিন রাখা যায় না, পোকায় ধরে। তাই সবদিক রক্ষা করেই ছাঁটাই নীতিমালাটি করা হবে।’

‘আমরা ১০ জেলায় একটা স্টাডি করিয়েছিলাম, সেখানে দেখা গেছে মিনিকেট ধানের জাতের চাষ হয়নি কিন্তু মিল ও বাজারে মিনিকেট চাল পাওয়া গেছে। কোনো কোনো জায়গার কৃষকেরা বলেছেন, আমরা মিনিকেট ধান চাষ করেছি। এক মিটিংয়ে একজন বলেছেন, সম্পা কাটারির জাতও তো ব্রি আবিষ্কার করেনি, এটা দেশীয় জাত। ভারতের বর্ডার এলাকায় মিনিকিট করে যে বীজ এসেছিল, স্থানীয়ভাবে সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে মিনিকিট বা মিনিকেট। স্থানীয় কিছু লোকজন বলছেন, মিনিকেট ধানের জাত আছে, আমরা চাষ করি। কিন্তু মিনিকেট নামে আমাদের ব্রি উদ্ভাবিত কোনো জাত নেই।’

খাদ্য-সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশে শুধু ব্রি উদ্ভাবিত জাতেরই চাষ হয় না। ট্রাডিশনালি চাষ হয় এমন অনেক জাতও রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে কৃষকরা মিনিকেট জাতের চাষ করে, সেই জাতটা ব্রি উদ্ভাবিত নয়। এটা ভারত থেকে এসেছে।’

নাজমানারা খানুম আরও বলেন, ‘তবে মিনিকেট ধানের জাত থেকে থাকলেও এর চাষ হয় খুবই কম। কিন্তু বাজারে ব্যাপকভাবে মিনিকেট পাওয়া যায়। ওই পরিমাণ তো বাংলাদেশে চাষ হয় না। ধরে নিলাম, ৫ শতাংশ মিনিকেট ধানের চাষ হয় কিন্তু বাজারে চালের ৫০-৬০ শতাংশই মিনিকেট। নিশ্চয়ই অন্য জাতের চালকে মিনিকেট নামে চালানো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘চালের ব্র্যান্ড নাম যাই হোক, আমরা চাই বস্তায় ধানের জাতের নামটা থাকুক। কিন্তু একটা সমস্যাও আছে। কৃষক অনেক সময় ধানের কোনো নির্দিষ্ট জাত সংরক্ষণ করে না। মোটা, চিকন ও মাঝারি- এই তিন ধরনের ধান আলাদা আলাদা করে রাখেন। কিন্তু জাতভেদে অনেক সময় রাখেন না। তখন মিলাররা এই ধান কিনে বস্তায় জাতের নামটা কীভাবে লিখবেন? আমরা কৌশল বের করছি, কীভাবে কী করা যায়।’

চাল অতিরিক্ত ছাঁটাই করার কারণে আমরা সবাই ভুগছি মন্তব্য করে খাদ্য-সচিব বলেন, ‘মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। আমরা বিদেশ থেকে পুষ্টিচাল এনে খাওয়াচ্ছি। আমি যদি আমার চালের পুষ্টিটা ধরে রাখতে পারি, তাতে আমাদের অনেক উপকার হবে।’

‘আমরা এমন একটা জায়গায় যেতে চাচ্ছি যে, আমাদের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে, আবার পুষ্টিটাও থাকবে। বোরো চাল তো আমন পর্যন্ত খেতে হবে, আমন খেতে হবে বোরো পর্যন্ত। চালটা তো আমাদের সেই পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই ছাঁটাই নীতিমালা করা হবে’- যোগ করেন সচিব।

কমিটির প্রধান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগ) খাজা আব্দুল হান্নান বলেন, ‘নীতিমালা করতে আমরা কাজ করছি। কী ধরনের, কী ধানের জাত আছে, কীভাবে কতটুকু ছাঁটাই হচ্ছে— সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলছি। ব্রি ও বারির বিজ্ঞানীরা আমাদের সঙ্গে আছেন। নীতিমালা করার জন্য আমরা এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই আছি।’

তিনি বলেন, ‘বাজারে যে চাল বিক্রি হয় তা কতটুকু ছাঁটাই করা উচিত। কতটুকু ছাঁটাই করলে পুষ্টি থাকবে, কতটুকু ছাঁটাই করলে থাকবে না— এ বিষয়গুলো আমরা দেখছি। ধানের বিভিন্ন জাত আছে কিন্তু মিনিকেট-নাজিরশাইল এমন দু-তিনটি নামের চাল কেন বেশি চলে, সবকিছুই আমরা পর্যালোচনা করবো। আমরা কেবল কাজ শুরু করেছি।’

খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, কমিটি প্রাথমিক খসড়া করার পর এটি নিয়ে কাজ করবে মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ)। তারা খসড়াটি সমৃদ্ধ করবে।

এফপিএমইউর মহাপরিচালক মো. শহীদুজ্জামান ফারুকী বলেন, ‘একটি কমিটি প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নের জন্য কাজ করছে, ওই কমিটিতে আমাদেরও দু-একজন অফিসার আছেন। তারা একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করালে আমরা সেটা নিয়ে কাজ করবো।’

ছাঁটাই নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘একটা বিষয় নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে- আমরা মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে চাল খাচ্ছি কিন্তু এ নামে কোনো ধানের জাত নেই। মূলত আমাদের যে জাতগুলো আছে, সেগুলো কেটে-ছেঁটে বা পলিশ করে চাল করা হচ্ছে। এতে আমাদের চালের যে পুষ্টির পরিমাণ তা কমে যাচ্ছে বা থাকছে না। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি।’

তিনি বলেন, ‘ছাঁটাই নীতিমালায় আমরা বলে দেবো, আপনি কতটুকু ছাঁটাই করবেন। আমরা বলছি, সাড়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশের বেশি চাল ছাঁটাই করা যাবে না। এটা মেইনটেইন করা গেলে চালের স্বাদ ও পুষ্টি ঠিক থাকবে।’

‘আমরা যে উদ্দেশ্যে চালগুলোতে জিংক ঢুকাচ্ছি, আয়রন ঢুকাচ্ছি, ভিটামিন ঢুকাচ্ছি। পুষ্টিসমৃদ্ধ নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করছি। অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের কারণে আমাদের সাধারণ মানুষ যদি সেই পুষ্টি না পায়, তাহলে আমাদের এত কষ্ট করে এ আবিষ্কার করে লাভ কী? এজন্য আমরা একমত হয়েছি যে, একটা নীতিমালা করতে হবে।’

এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘নীতিমালায় বলে দেবো, আপনি কত শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করবেন। আমরা বলবো, যে ধান দিয়ে চাল করছি, সেই ধানের দাম চালের বস্তায় লিখতে হবে। আমরা স্টেপ বাই স্টেপ এগোচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। মানুষ চিকন চাল খেতে চায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে। চাল ছেঁটে চিকন করে বিক্রি করছে। মোটা চাল চিকন করার ক্ষেত্রে বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত) যেটা থাকে, সেটা আরও বেশি দামে বিক্রি করে। গুঁড়াটা বিস্কুট ফ্যাক্টরি, স্টার্চসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।’

‘ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, এই ধরনের পুষ্টিহীন চিকন চাল আমরা খাবো না। যে ধান সেই নামেই চাল খাবো। এখন যে জাতগুলো আছে, বেশিরভাগই চিকন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ।’

শাহজাহান কবীর বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি, মিলাররা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করে। হাইব্রিড চালগুলো মোটা হয়। এগুলো তারা পলিশ করে চিকন করেন। কিন্তু আপনি বাজারে গিয়ে হাইব্রিড পাবেন না।’

 

প্রধান সম্পাদকঃ
মতিউল আলম

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ
মাকসুদা আক্তার