প্রতীক ওমর বগুড়া থেকেঃ, সাংবাদিকতার পথিকৃত মোনাজাতউদ্দিন। এই পেশার মানুষদের দৃষ্টির মণিকোঠায় জায়গা করে আছেন তিনি। অবহেলিত উত্তর জনপদজুড়ে তার অবাধ বিচরণ ছিল। সংবাদের পেছনে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন। কেমন ছিলেন এই স্বপ্নের মানুষটি? কীভাবে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে কথা বের করে আনতেন? প্রান্তিক মানুষদের প্রতি তার কতোটুকু ভালোবাসা ছিল? এসব জানতে টানা তিন দিন রংপুরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে কথা বলেছি মোনাজাতউদ্দিনের শিষ্য, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে। রংপুরের জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে সকাল দশটায় বাইকে রওনা দেই গঙ্গাচড়া উপজেলার মোহিপুরের উদ্দেশ্যে। পিচ ঢালাপথ। রাস্তার দুই ধারে মাঝেমধ্যেই পুরাতন শতবর্ষী বিভিন্ন গাছ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রতিবেদনটি আজ মঙ্গলবার দৈনিক মানবজমিনের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে।
ছায়াময় পথ। শহর থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দেখা মেলে তিস্তা নদীর। শুকিয়ে বালু চরে রূপ নিয়েছে। দৃষ্টিনন্দন শেখ হাসিনা ব্রিজ এই নদীর এপার-ওপারের বন্ধন তৈরি করেছে। ব্রিজের নিচে তামাকসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য চাষ করেছেন চাষিরা। ব্রিজ পার হয়ে মূল রাস্তা থেকে একটি বালির রাস্তা নেমে গেছে ইচলী গ্রামের দিকে। ইচলী স্থানীয় লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের একটি চরগ্রাম। বালির রাস্তা দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার পর দেখা মেলে প্রখ্যাত সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের খোঁজ নিতেই মূলত এই মরুর পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে হয়েছে।
একতলা ভবনের স্কুলের সামনে জাতীয় পতাকা মৃদু বাতাসে উড়ছে। শ্রেণিকক্ষে বসে খুদে কয়েকজন শিক্ষার্থী বই-খাতা নাড়াচাড়া করছে। ধু-ধু বালির চর। দৃষ্টি যতদূর যায় বালি আর বালি। সেই বালির মধ্যেই এক টুকরো মাটির উপর স্কুলঘরটি একাকিত্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিস্তা ভাঙতে ভাঙতে ওই স্কুলের ঠিক দশ হাত দূরে এসে ঠেকেছে। আগামীর বন্যায় এই স্কুলটি টিকে থাকবে কিনা এই সন্দেহ স্থানীয়দের মধ্যে বিরাজ করছে।
স্কুলের মাঠে প্রবেশ করতেই উৎসুক কয়েকজন ব্যক্তি ছুটে আসেন। শহুরে মানুষ দেখলে তারা মূলত যাচিয়ে সাহায্য করতে কাছে আসেন। চরের সহজ সরল মানুষগুলোর এমন গুণ সহজেই পরিলক্ষিত হয়। তাদের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে চেনেন? সবাই এক বাক্যে উত্তর দিলেন হ্যাঁ তার নাম আমাদের চেনা। আমরা তার গুণের কথা অনেক শুনেছি। তাদের কেউই মোনাজাতউদ্দিনকে স্বচক্ষে দেখেননি।
মোনাজাতউদ্দিনের স্মৃতি ধরে রাখার মতো এই স্কুলটি ছাড়া আর কিছুই নেই। নেটজ বাংলাদেশ ও বিএমজেড জার্মানের অর্থায়নে জাগরণী ফাউন্ডেশন বিদ্যালয়টি পরিচালনা করে আসছে ২০১৪ সালের ২৯শে ডিসেম্বর থেকে। বিদ্যালয়টির নাম দেয়া হয়েছে ‘মোনাজাতউদ্দিন আনন্দলোক বিদ্যালয়’।
ওই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য একজন সাধারণ কৃষক দুলাল উদ্দিন জমি দান করেছেন। তার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, মোনাজাতউদ্দিন এই এলাকার মানুষের হৃদয়জুড়ে আছেন। আমি মোনাজাতউদ্দিনকে কখনো দেখিনি। আমার বড় ভাইয়ের কাছে তার অনেক গল্প শুনেছি। একটি এনজিও এসে যখন মোনাজাতউদ্দিনের নামে স্কুল করার জন্য জমির খোঁজ করছিলেন আমি তখন সঙ্গে সঙ্গে জমিটি দান করি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এমন গুণীজনের স্মৃতিচিহ্ন একমাত্র স্কুলটিও তিস্তার ঠিক মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী বন্যায় টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে স্কুলঘরটি রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করলেও আজ পর্যন্ত কেউ পরিদর্শন করতেও আসেননি।
স্কুলের শিক্ষক মিটুল মিয়া এবং স্থানীয় আরেক কৃষক জামাল মিয়াও স্কুলটি রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান।
মোনাজাতউদ্দিন আনন্দলোক বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে আবারো রওনা দিতে হলো অন্য চরের উদ্দেশ্যে। সেখানে একজন প্রবীণ ব্যক্তির খোঁজে ছুটে যাই। ওয়াহেদুজ্জামান মাবু। এক সময় লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মাবু। বাড়ি মোহনপুর এলাকায়। খুঁজতে খুঁজতে তার বাড়ির সন্ধান মেলে। তিস্তার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে গ্রামটি। নিবিড় পরিবেশ। তিস্তার তলানিতে শান্ত পানি নীল বর্ণ ধারণ করেছে। ওয়াহেদুজ্জামান মাবু বিকালের মৃদু রোদে প্লাস্টিকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মাবু মোনাজাতউদ্দিনের একজন ভক্ত ছিলেন। সংবাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি অনেক সময় মোনাজাতউদ্দিনের সঙ্গে সময় দিয়েছেন। মোনজাতউদ্দিনের লেখা বিখ্যাত বই ‘লক্ষ্মীটারী’ যখন লিখেন তখন তিনি (মাবু) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময় বেশ কিছুদিন মোনাজাতউদ্দিন লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে রাতযাপন করেছিলেন এবং সেখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন। মাবু ওই সময় তার একান্ত সহযোগী হিসেবে সঙ্গে ছিলেন। বইটিতে মাবু সাহেবের সঙ্গের ওই সময়ের বেশকিছু স্মৃতিও উল্লেখ করেছেন মোনাজাতউদ্দিন।
একই প্রশ্ন ওয়াহেদুজ্জামান মাবুর প্রতি। কেমন দেখেছেন মোনাতাজউদ্দিনকে? কীভাবে তিনি সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন? উত্তরে ওয়াহেদুজ্জামান মাবু বলেন, সরজমিন সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক বলা যায় মোনাজাতউদ্দিনকে। তিনি মানুষের মনের মধ্যে সহজেই প্রবেশ করতে পারতেন। ফলে মানুষ ভেতরে পুষে রাখা সব তথ্য অকপটে তার কাছে বলে দিতেন। তিনি আরও বলেন, মোনাজাতউদ্দিনের একটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। কোথায় সংবাদ আছে তার চোখ সহজেই ধরে ফেলতো। সত্তর দশকের শেষের দিকে মঙ্গার রেশ তখনো কাটেনি। ওই সময়ের একটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করে বলেন, একদিন লক্ষ্মীটারীর একটি হাটে গেছেন মোনাজাতউদ্দিন সংবাদ সংগ্রহের জন্য। সেই হাটে অনেকেই বিক্রির জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র এনেছেন। মোনাজাতউদ্দিন হাটে ঘুরছেন। ঘুরতে ঘুরতে একজন বয়স্ক মানুষের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। তার গায়ে হাত দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন। লোকটির নাম আমার এখনো মনে আছে। জিয়াপউদ্দিন। লোকটি অভাবের তাড়নায় তার থাকার ঘরের তিনটি বাঁশের খুঁটি খড়ি হিসেবে বিক্রির জন্য এনেছেন। মোনাজাতউদ্দিন তাকে জিজ্ঞেস করেন ঘরের খুঁটি কেন বিক্রি করতে এনেছেন? ঘর পড়ে যাবে না? উত্তরে লোকটি বলেন, যে ঘরে খাবার নেই, সেই ঘর থেকে কি হবে? পেটের খিদা নিয়ে ওই ঘরে কেমনে থাকবো? ঘর পড়ে পড়ুক। আমি অবাক হয়েছিলাম সেদিন মোনাজাত ভাই কেমনে বুঝলো ওই লোকটি ঘরের খুঁটি উপড়ে বিক্রি করতে এসেছিলেন। তার বিচক্ষণ দৃষ্টি অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল।
সন্ধ্যা পর্যন্ত এমনি ভাবে বিভিন্ন চরে গিয়ে মোনাজাতউদ্দিনের কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে রাতে আবারো রংপুর ফিরি। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর। হোটেলে গিয়ে সামান্য সময় বিশ্রাম নিয়ে আবারো বেরিয়ে পড়ি। এবার লক্ষ্য পেশাগতকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা। শহরের পায়রা চত্বরে যুগান্তরের ব্যুরো চিফ মাহবুব রহমান হাবুর অফিস। তার সঙ্গে আগেই ফোনে কথা হয়েছিলো। তিনি অপেক্ষা করছেন। তার অফিসে গিয়ে কফি খেতে খেতে মোনাজাতউদ্দিনকে নিয়ে কথা শুরু হয়। মাহবুব রহমান হাবু বলেন ১৯৯১ সালে সাংবাদিকতা শুরু করি। বিভিন্ন কাগজে কাজ করার পর আমি যখন ভোরের কাগজে কাজ শুরু করি তখন আমার লেখাগুলো মোনাজাত ভাই পড়তেন। তখন থেকেই আমাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। একসময় তিনি আমাকে সংবাদে তার সঙ্গে কাজ করার জন্য বললেন এবং যোগদান করালেন। এরপর থেকেই তার সঙ্গে আমার একনিষ্ঠভাবে বিচরণ। আমি কাছে থেকে তাকে দেখেছি। তিনি একজন সংবাদপাগল মানুষ ছিলেন। কোনো সংবাদের চিন্তা তার মাথায় ঢুকলে সেই সংবাদের তথ্য সংগ্রহ করে পত্রিকা অফিসে ফ্যাক্স না করা পর্যন্ত তিনি খেতেন না। হাবু আরও বলেন, আমার একটা লোভ ছিল মোনাজাত ভাইয়ের সঙ্গে রিপোর্ট করার, তার রিপোর্টের সঙ্গে আমার নাম থাকবে। কিন্তু আমি কোনোদিন মোনাজাত ভাইকে রিপোর্টে আমার নাম দিতে বলিনি। কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়ে যে রিপোর্টগুলো উনি করতেন সেই রিপোর্টগুলোতে আমার নাম তিনি নিজ থেকেই লিখে দিতেন। পরের দিন পত্রিকায় তার নামের সঙ্গে আমার নাম ছাপা হতো। তখন কি যে আনন্দ লাগতো বলে বোঝানো যাবে না। তিনি অনুজদের উপরে তুলতে খুব উদার ছিলেন। তার লেখার সঙ্গে আমার নামই শুধু নয় তিনি যখন যে জেলায় রিপোর্টের জন্য গিয়েছেন সেই জেলার প্রতিনিধির নামও তার লেখার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। অনুজদের প্রতি এমন উদারতা বর্তমান সাংবাদিকতায় দেখা যায় না। মোনাজাতউদ্দিন এ জন্যই মোনাজাতউদ্দিন হয়ে উঠেছেন।
মোনাজাতউদ্দিন সাংবাদিকতার পাশাপাশি মঞ্চ নাটক নিয়েও কাজ করেছেন। নাট্যজন হিসেবেও তিনি রংপুর তথা গোটা দেশ আলোচিত হয়ে আছেন। মোনাজাতউদ্দিনের সঙ্গে নাটক নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী বিপ্লব প্রসাদ। তার মুখেও মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিভার কথা শুনলাম। বিপ্লব প্রসাদ বলেন, মোনাজাতউদ্দিন যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন ঠিক তখন থেকেই নাটকের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। মোনাজাত ভাইয়ের হাতের লেখা অত্যন্ত সুন্দর। নাটকের পোস্টারগুলো তিনি সারারাত জেগে হাতে তৈরি করতেন। পরে সেই পোস্টারগুলো হোটেলগুলোতে লাগানো হতো। সবাই তার হাতের তৈরি পোস্টারগুলো মুগ্ধতা নিয়ে দেখতো। সে সময় মঞ্চ নাটকের দর্শকও ছিল প্রচুর। মোনাজাত ভাই বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে সংবাদ লিখতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন সেই এলাকায় এক সপ্তাহ কখনো পনেরো দিন অবস্থান করতেন। কাজ শেষে রংপুরে আসলেই আমাদের শিখা সংসদে চলে আসতেন। তিনি আরও বলেন, আমরা ৭৫ পরবর্তী সময়ে নাটক করার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে তার লেখা নাটক ‘নন পলিটিক্স’ মঞ্চায়ন করা হয়। নাটকটির নাম ‘নন পলিটিক্স’ হলেও পলিটিক্সে ভরা ছিল। ওই নাটক নিয়ে তখন ভারতের সাংবাদিকরা কৌতূহল নিয়ে মোনাজাত ভাইয়ের ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কথা বলা ঠিক হবে না ভেবে তিনি কৌশলে কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেননি সেদিন।
বিপ্লব প্রসাদ আরও বলেন, মোনাজাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তিনি যেমন পেশাগতভাবে একজন আলোচিত মানুষ ছিলেন তেমনি মানুষ হিসেবেও অনেক মানবিক ছিলেন। তিনি বলেন, ’৭৪ পরবর্তী মঙ্গাচলাকালীন একদিন একটি বস্তিতে রিপোর্ট করার জন্য গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে শিখা সংসদে এসে সবাইকে বললেন আমরা আজ রাতে কেউ খাবার খাবো না। আমরা জিজ্ঞেস করলাম কেন? তিনি বললেন- আমাদের সব খাবার বস্তির অনাহারি মানুষদের রাতে খাওয়াবো। তার কথায় আমরা সবাই রাজি হয়ে যাই। কথা মতো ঘুমন্ত বস্তিবাসীদের খুপরি ঘরে গিয়ে সবাইকে মাংস দিয়ে রান্না করা খাবার দিয়ে আসি। সেদিন ওই অভুক্ত মানুষগুলো রাতে খাবার পেয়ে আনন্দে হাউমাউ করে কান্না করেছিলো। সেই দৃশ্য আজও আমার মনে আছে। মোনাজাতউদ্দিন এজন্যই আজও বেঁচে আছেন উত্তরজনপদের অবহেলিত মানুষদের মনের কুঠিরে।
রংপুরের আরেক সাংবাদিক মানিক সরকার মানিক বলেন, মোনাজাত ভাইয়ের কর্মকাণ্ড কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এক সঙ্গে কাজ করা, পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর ফলে অনেক গভীরভাবে তাকে বোঝার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। তিনি সাংবাদিক হিসেবে এতটাই দায়িত্ববান ছিলেন তাকে কাছে থেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। রংপুরের একটি কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে বসে তিনি সংবাদ লিখতেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে সেই কুরিয়ার সার্ভিস অফিসেই বুকে ব্যথা নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে কয়েকজন কোলে নিয়ে প্রেস ক্লাবে আনেন। আমি তখন কয়েকটা চেয়ার একজায়গায় করে তাকে শুয়ে দিয়ে দ্রুত একটা মোটরসাইকেল নিয়ে ডা. গোপাল চন্দ্র সরকারকে ডেকে আনি। ডাক্তার তাকে দেখে কিছু ওষুধ দিয়ে বললেন মোনাজাতউদ্দিন মাইলস্টোক করেছেন। তাকে পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে হবে। পরে মোনাজাত ভাইকে বাসায় নিয়ে ভাবীকে বলে আসি তাকে যেন বের হতে না দেয়া হয়। সারা রাত বিশ্রাম নিয়ে একটু সুস্থ হয়েই মোনাজাত ভাই পরের দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে গাইবান্ধা চলে যান সংবাদের খোঁজে। দায়িত্বপালনের এমন উদাহরণ কেবলমাত্র আমরা মোনাজাত ভাইয়ের মধ্যেই পেয়েছি।
মোনাজাতউদ্দিনের আরেকজন ঘনিষ্ঠ মানুষ ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে আমি পড়ালেখার জন্য রংপুরে আসি। ওই বছরেই টাউন হল মাঠে ২১শে ফেব্রুয়ারির একটা অনুষ্ঠানে আমরা কবিতা পড়ছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে মোনাজাত ভাই ছিলেন। আমি তখনো তাকে চিনতাম না। আমার কবিতা পড়া শুনে তিনি একজনের মাধ্যমে আমাকে ডেকে নেন। পরে রংপুরের একটি বিখ্যাত শিঙ্গাড়া হাউজে নিয়ে শিঙ্গাড়া খাওয়ালেন। ওই দিন সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে নানাবিধ আলাপ করলেন তিনি। ওই দিন থেকেই তার সঙ্গে আমার শখ্যতা তৈরি হয়। পরে খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল একটি পত্রিকা প্রকাশের চিন্তা করেন। সেই পত্রিকায় বাটুল সাহেব মোনাজাত ভাইকে সঙ্গে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। মোনাজাত ভাই রাজি হয়ে যান। পরে পুরো পত্রিকা চালানোর জন্য তিনি দায়িত্ব নেন। সে সময় আমিসহ ১৫ জন তরুণকে ডেকে একটি ট্রেনিংয়ের আয়োজন করেন। পরে লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা শেষে আমিসহ তিনজনকে মোনাজাত ভাই পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ দিলেন। পত্রিকাটির নাম ‘দাবানল’। পরে বেশ পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে পত্রিকাটি। তার হাতেই মূলত আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। তার সংবাদের বিষয়বস্তু নির্ধারণগুলো ছিল অসাধারণ। ছোট ছোট বিষয়গুলোকে তিনি নান্দনিকভাবে তার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তরুণ লেখকদের এগিয়ে নিতে তিনি পত্রিকায় চিঠিপত্র কলাম ছাপতেন নিয়মিত। ছোট ছোট বিষয়গুলো নিয়ে তিনি চিঠিপত্র লিখতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন।
চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন ১৯৪৫ সালে রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী আলিমউদ্দিন আহমদ। মাতার নাম মতিজাননেছা। তার পিতা রংপুর পৌরসভার ঊর্ধ্বতন কারণিক, রংপুর পুলিশ দপ্তরের প্রধান কারণিক এবং শেষে রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাবরক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
মোনাজাতউদ্দিন রংপুরের কৈলাশগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর তার শিক্ষাজীবনের বিরতি ঘটে। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তিনি বৈবাহিক জীবন শুরু করেন।
মোনাজাতউদ্দিন ষাটের দশকের একেবারেই শুরুতে বগুড়া থেকে প্রকাশিত ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে সংবাদপত্রে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকায় রংপুরের স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি। ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা বন্ধ হলে তিনি কিছু সময় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। পরে ১৯৭৬ সালে আবার সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে আসেন। ওই বছরের ৪ঠা জুন তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাঞ্চলের বার্তা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ ছেড়ে ওই বছরের ২৪শে এপ্রিল তিনি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’র সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন।
সাংবাদিকতা জগতের এই মহাপুরুষ ১৯৯৫ সালের ২৯শে ডিসেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাটে লঞ্চের ছাদ থেকে নদীতে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিলো সেই রহস্যের ঘোর এখনো কাটেনি। তার সহকর্মীদের ধারণা তাকে দুর্বৃত্তরা লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলে হত্যা করেছে। সহকর্মীরা তাদের এই কথার যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, মোনাজাতউদ্দিন খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তৎকালীন স্থানীয় রাস্তায় দ্রুতগতির বাহন ছিল টেম্পো। রাস্তায় অনেক দ্রুত চলে বিধায় ভয়ে তিনি কখনো টেম্পোতে উঠতেন না। রাস্তা যত দূরের হোক না কেন তিনি রিকশায় যেতেন এবং রিকশাওয়ালাকেও দ্রুতগতিতে চালাতে দিতেন না। সহকর্মীরা মনে করেন এমন ভীতু মানুষ কখনো লঞ্চের ছাদে উঠতে পারে না। বরং তিনি লঞ্চের তেল চুরির সংবাদ করতে যাওয়ার কথা জানতে পেরে কোনো সঙ্গবদ্ধ গোষ্ঠী তাকে লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলে হত্যা করে থাকতে পারে। সে সময় তার মৃত্যু নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে আইনি কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে মোনাজাতউদ্দিনের মৃত্যু আজও রহস্যময় হয়েই রয়েছে। রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় মোনাজাতউদ্দিনকে কবরস্থ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মোনাজাতউদ্দিন গাইবান্ধার কালা সোনার চর নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন করেছিলেন। ওই সময় উত্তরাঞ্চলের মানুষের ঢাকা যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাট হয়ে। ফুলছড়ি থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত লঞ্চ/ফেরি চলাচল করতো। সেই লঞ্চগুলোর সরকারি তেল চুরির নিরাপদ জায়গা ছিল ঘাট থেকে একটু দূরের চরগুলোতে। সেখানে লঞ্চ ভিড়িয়ে তেল চুরি করে বিক্রি করতো অসাধু কর্মকর্তারা। মোনাজাতউদ্দিন মৃত্যুর দিন ওই তেল চুরির দৃশ্য ধারণ এবং তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলেন।
নতুন প্রজন্মের অনেকেই আজ এই প্রথিতযশা সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে ভুলতে বসেছে। তার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য উত্তরজনপদে উল্লেখ করার মতো কিছুই নেই। পৈতৃক ভিটা গঙ্গাচড়ার মরনিয়া গ্রাম তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়েছে। বংশের লোকজন নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সবাই ছিন্নভিন্ন হয়ে একেকজন একেক জায়গায় বসতি গড়েছেন। মোনাজাতউদ্দিনের রংপুর শহরের পৈতৃক বাড়িটাও ভাইয়েরা দখলে নিয়েছে মর্মে অভিযোগ আছে। স্ত্রী নাসিমা মোনাজাত ইতি কন্যা মাহফুজা মাহমুদ চৈতি এবং হোসনাতুল ফেরদৌস সিঁথির সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। একমাত্র ছেলে আবু ওবায়েদ জাফর সাদিক সুবর্ণ ১৯৯৭ সালে প্রয়াত হয়েছেন। মোনাজাতউদ্দিন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার একুশে পদক (মরণোত্তর) পেলেও তার স্মৃতি রক্ষার জন্য এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কিছু করার উদ্যোগ কেউ নেয়নি।