You must need to login..!
Description
মতিউল আলম, বিএমটিভি নিউজঃ ৩০ বছরের যুবক শহিদুল ইসলাম। সে সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম আটুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বলেন, আমার জন্মের পর এই প্রথম দেখলাম লোনা পানির মাটিতে ধান চাষ করা যায়। ফলন দেখে আমরা মুগ্ধ। লোনা পানির জমিতে সোনা ফলানোর জন্য ধন্যবাদ বিনাধান-১০কে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমার বাপ দাদারা লোনা পানি ও লোনা মাটিতে ধান হয়না বলে ঘের করে চিংড়ি চাষ শুরু করেছিল। এখন চিংড়ি চাষেও লস। এই মুহুর্তে তারা খুঁজছিল বিকল্প কি করা যায়। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে ও কৃষি অফিসের মাধ্যমে জানতে পারে লবণ সহিষ্ণু বিনাধান-১০ চাষ করা যায় বোরো মৌসুমে। বিনার ফোন নাম্বার ও কৃষি অফিসের ঠিকানা বের করে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে বীজ ও পরামর্শ নিয়ে আটুলিয়া গ্রামের ৩০জন কৃষক ৩’শ বিঘা জমিতে বিনাধান-১০ চাষ করে। যা আশাতীত বাম্পার ফলন হয়েছে। লবণাক্ত জমিতে প্রতি বিঘাতে ১৫ থেকে ২৫ মন ধান হয়েছে। ভাল ফলন পেয়ে কৃষকরা আনন্দে আত্মহারা। যারা চাষ করে নাই বিনাধানের ফলন দেখে হতবাক। তাদের আফসোস এমন ধানের জাত আছে জানলে বীজ সংগ্রহ করে তারাও এই ধান চাষাবাদ করতেন। হাজার হাজার কৃষক বীজ সংগ্রহ করে বিনাধান-১০ চাষের পরিকল্পনা করছেন।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) সাতক্ষীরা উপকেন্দ্র এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বাবুল আক্তার জানান, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ১০লাখ হেক্টর লোনা পানির জমি রয়েছে। লবণাক্তার কারণে এসব জমিতে ধান চাষ করা যায় না। এর মধ্যে সুখবর হচ্ছে এবছর বিনা উপকেন্দ্র ও কৃষি সম্পসারণ বিভাগের মাধ্যমে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, ঝালকাটি, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ৪ হাজার হেক্টর জমিতে বিনাধান-১০ চাষ করা হয়েছে এবং বাম্পার ফলন হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এর বিজ্ঞানীরা এই বিশাল লবণাক্ত অঞ্চলকে ধান চাষের আওতায় আনতে স্বল্পকালীন লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনে গবেষনা শুরু করে। বিনার বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় ২০১০ ও ২০১২ সালে আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ও বিনার বর্তমান মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম যথাক্রমে লবণ সহিষ্ণু বিনাধান-৮ ও বিনাধান-১০ আবিস্কার করেন, যা দেশের লবণাক্ত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আশীর্বাদ স্বরূপ।
বিনাধান-১০ চাষে বাড়তি সুবিধা হল চিংড়ি চাষ করেও শুষ্ক মৌসুমে বিনাধান-১০ চাষ করা যায়। বিনাধান-১০ চাষে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে স্বল্পকালীন ধানের জাত, চাষাবাদে খরচ কম, সার, কীটনাশক কম লাগে। সেই সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী। মানুষের খাদ্য চাহিদা পুরণের পাশাপাশি গো খাদ্য খড় পাচ্ছে। সময় মত চারা রোপন করলে ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যা আসার আগেই ধান কেটে ফসল ঘরে তোলা যাবে। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপÍাহে বীজতলা করে ৩০/৩৫ দিনের চারা ডিসেম্বর মাসে জমিতে চারা রোপন করলে মার্চ মাসে অর্থাৎ ১২৫-১৩০ দিনের মধ্যে পাকাধান কর্তন করা সম্ভব। ফলে বর্ষার আগেই কৃষক তার ঘরে নিরাপদে ধান তুলতে পারবে কৃষকরা ধারণা করছেন ধান কেটে আনার পর ধান গাছের নীচের অংশ পচে মাছের খাদ্য হিসেবে কাজে লাগবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গেলো কয়েক বছর ধরে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ। ফলে বারবার বাঁধ ভেঙে লবণ পানি প্রবেশ করেছে ফসলি জমিতে। তবে সেসব প্রতিকূলতার মাঝে কৃষকদের আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু জাতের ধান।
কৃষিবিভাগ বলছে, সাতক্ষীরার সাত উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলার ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। তবে শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকার ফসলি জমিতে উচ্চমাত্রায় লবণ রয়েছে। এসব উপজেলায় উচ্চমাত্রার লবণসহিষ্ণু বিনাধান-১০ জাতের ধান আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। ফলে জেলায় স্বল্পমাত্রার লবণসহিষ্ণু জাতের ধানের আবাদ বাড়ছে।
কৃষকরা বলছেন, লবণসহিষ্ণু জাতের ধান চাষে ভালো ফসল ফলছে। ফলন দেখলে মন ভরে যায়। তবে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় বীজ না পাওয়ায় অনেক কৃষক ধানচাষ করতে পারছেন না।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে এখন উজান থেকে মিষ্টি পানির কোনো প্রবাহ নেই। কিছু এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে লবণপানি তুলে মাছচাষ করা হয়। এছাড়া ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় লবণপানি প্রবেশ করে। এতে আমাদের অধিকাংশ ফসলি জমিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে।
শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম আটুলিয়া গ্রামের কৃষক মোসলেম উদ্দিন (৬০) বলেন, তিনি এই প্রথম ১৮ বিঘা জমিতে বিনাধান-১০ চাষ করেছেন এবং ভাল ফলনও হয়েছে। আটুলিয়া গ্রামের কৃষক অশোক কুমার মন্ডল বলেন, আমাদের এলাকার অধিকাংশ জমি উচ্চমাত্রায় লবণাক্ত। এখানকার বেশিরভাগ জমিতে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ করা হয়। প্রায় ২০ বছর পর আমি এ বছরই প্রথম মাছের ঘের শুকিয়ে লবণসহিষ্ণু বিনা-১০ জাতের ধানচাষ করি। ফলন ভালো হয়েছে।
কালিগঞ্জ উপজেলার বারশ্যামলা গ্রামের কৃষক আবদুল গফুর বলেন, লোনা পানির কারণে এলাকার ধান চাষ হয়না ৩০ বছর ধরে। মাটির নীচের পানিতেও লবণ রয়েছে। বোরো মৌসুমে সব জমি পতিত থাকতো এ প্রথম বিনাধান-১০ চাষ করলাম। ফলন ভালো হয়েছে। আমার জমিতে ধান দেখে আগামীতে অনেক চাষী বিনাধান-১০ চাষ করবে বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
আশাশুনি উপজেলার কুল্যা গ্রামের কৃষক আক্তার হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে ৪০ বিঘা জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের ধান আবাদ করেছি। গত মৌসুমে এ জাতের ধান চাষ করে লবনাক্ত জমিতে বিঘা প্রতি ১৫ থেকে ২০ মণ পর্যন্ত ধান পেয়েছি।
তালা উপজেলার হরিনখলা গ্রামের অরবিন্দ সরকার বলেন, ২বছর ধরে বিনাধান-১০ চাষ করে লাভবান হচ্ছি। এই ধানে রোগ বালাই নেই। গত বছর বিঘাতে ২৫ মন ধান পেয়েছি এবং সাড়ে ৩ লাখ টাকা বিক্রি করে খরচ বাদে ধান বিক্রি আড়াই লাখ টাকা লাভ হয়েছে। এবছর আরো বেশি লাভবান হব। আমার জমির ফলন দেখে বীজ নিতে অনেক কৃষক আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বিনা উপকেন্দ্র সাতক্ষীরার ইনচার্জ ড. বাবুল আক্তার বলেন, সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় এলাকার ফসলি জমিতে ৮ থেকে ১৪ ডিএস মাত্রার লবণাক্ততার উপস্থিতি রয়েছে। এ মাত্রার লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদন প্রায় অসম্ভব। তবে এসব জমিতেও বিনা-১০ জাতের ধান আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। এই ধান ১২ থেকে ১৪ ডিএস মাত্রা পর্যন্ত লবণ সহ্য করতে পারে।
বাগেরহাট মোড়লগঞ্জ উপজেলার কালিবাড়ীর কৃষক মোঃ শাহিন বলেন, এই প্রথম ১৮ বিঘা জমিতে বিনাধান-১০ চাষ করে ২’শ মণ ধান পেয়েছি। এই জমিতে ২০ বছর আগে বোরো ধান চাষ করা যায়নি।
খুলনা বটিয়াঘাটা উপজেলার সানকেমারী, গ্রামের কৃষক তরুণ কুমার গোলদার বলেন, তিনি এই প্রথম ১৭৫ শতাংশ জমিতে বিনাধান-১০ ধান চাষ করেছেন। ভাল ফলন হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. নুরুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরায় উচ্চমাত্রার লবণসহিষ্ণু জাতের ধানের আবাদ বাড়ছে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা লবণসহিষ্ণু জাতের ধানচাষে আগ্রহী হচ্ছেন। জেলায় এবছর ১২৬০ হেক্টর জমিতে লবণ সহিষ্ণু বিনাধান-১০ এর আবাদ হয়েছে এবং ফলনও ভাল জেলা কৃষি বিভাগ থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এবিষয়ে আমরা কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ ও মাঠ দিবস করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ও লবণসহিষ্ণু বিনাধান-১০ এর উদ্ভাবক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, দেশের ১০ লাখ হেক্টর জমিতে ৮ থেকে ১৪ ডিএস মাত্রা পর্যন্ত লবণাক্ততা রয়েছে, এর প্রায় ২০শতাংশ জমিতে লবণাক্ত সহনশীল বিনাধান-১০ জাতের ধানের চাষ হচ্ছে। কমপক্ষে ৮ লক্ষ হেক্টর জমি ধান চাষের আওতায় আসলে এই অঞ্চলের ধান উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে যাবে। এই অঞ্চলের খাদ্য চাহিদা পুরণসহ দারিদ্র বিমোচন ও কৃষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা কয়েকগুন বেড়ে যাবে বলে আশাকরি। কৃষকের মাঝে এ ধানের জাত দ্রুত বিস্তারের জন্য বিএডিসিকে পর্যাপ্ত বীজ উৎপাদন করতে হবে। এবং কৃষক পর্যায়ে মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
তিনি বলেন, বিনা-১০ ধান ১২-১৪ ডিএস মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে। আশা করছি আগামীতে এই অঞ্চলে এই ধানের চাষ আরও বাড়বে। আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে অনেক প্রান্তিক কৃষক সময়মতো লবণাসহিষ্ণু জাতের ধান বীজ সংগ্রহ করতে পারেন না। তাদেরকে বিনার পক্ষ থেকে স্থানীয় কৃষি বিভাগের বীজ সরবারহ করা হবে। এ জন্য বিনা ও কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ##