প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণঃ  ত্রিশালের সেই আলোচিত নবজাতকের জন্ম যেভাবে

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণঃ ত্রিশালের সেই আলোচিত নবজাতকের জন্ম যেভাবে

BMTV Desk No Comments

 মতিউল আলম, বিএমটিভি নিউজঃ   তখন সকাল ১১টা। ট্রাক চাপায় স্ত্রী সন্তানসহ নিহত জাহাঙ্গীর আলমের বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল প্রতিবন্ধী মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু তার নাতনী জান্নাত (৮) ও নাতি এবাদ (৫)কে নিয়ে পাশাপাশি তিনটি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শোক প্রকাশ করতে ও সাহায্য সহযোগিতা করতে আসছেন। একের পর এক ফোন আসছে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া কন্যাশিশুটিকে দত্তক নেয়ার। মোস্তাফিজুর রহমান কললিস্ট দেখে বলছিলেন সকাল থেকে এ পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি ফোন এসেছে শিশুটিকে দত্তক নেয়ার জন্য। তিনি বলেন, সবাই দোয়া করেন, যদি বেঁচে থাকে তবে প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে এদের মানুষ করা যায় তাই করবো। ওদিকে নিহত রত্নার পরিবারও চিন্তিত তার রেখে যাওয়া তিন সন্তানকে নিয়ে। স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতেন রত্না। সেখান থেকেই ময়মনসিংহে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। নিহত জাহাঙ্গীরের আরও দুই সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এর আগে।জাহাঙ্গীরের এক চাচা এবং এক ভাইয়ের মৃত্যু হয় সড়কে। পরিবারের পাঁচ সদস্যের এমন মৃত্যুতে বৃদ্ধ মোস্তাফিজুর রহমান যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।


তিনি বলেন, আমি প্রতিবন্ধী। আমার স্ত্রী সুফিয়াও প্রতিবন্ধী। আমাদের আয়-রোজগারের একমাত্র উপায় একটি চা-পানের দোকান। এদেরকে লালন-পালন করার অর্থ সম্পদ আমার নেই। প্রশাসন আমাদের দু’জনকে গতকাল ২টি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত ৭-৮ জন নগদ ২৫ হাজার টাকা ও চাল-ডালসহ কাপড় চোপড় দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। ওদিকে দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যু হলেও সড়কে ভূমিষ্ঠ শিশুটির প্রতি কৌতূহল সবার। মানুষজন জানতে চাইছেন কেমন আছে শিশুটি। কারা তাকে লালন-পালন করবে। অনেকে শিশুটিকে সহায়তা দিতেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। যেভাবে জন্ম ও উদ্ধার শিশুটির: ত্রিশালে ট্রাক চাপায় বাবা-মা ও বোন নিহত হওয়ার সময় অলৌকিকভাবে ভূমিষ্ট হয় গর্ভের শিশু কন্যা সন্তানটি। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকারীর একজন আসাদুজ্জামান সেলিম। তিনি হচ্ছেন ঘটনাস্থলের পূর্ব পাশের নিরাপদ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ঘটনার সময় তিনি চেম্বারে ছিলেন। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ছুটে যান। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ৩টি লাশ পড়ে আছে। একজন পুরুষ, একজন মহিলা ও আরেকটি শিশু কন্যা। কন্যা শিশুটি তখন নড়াচড়া করছিল।

মহিলার পাশে একটি নবজাতক শিশু পড়ে আছে। নবজাতকের নাড়ি মায়ের সঙ্গে সংযুক্ত, নবজাতকটি নড়াচড়া করছে। সেলিম বলেন, এ সময় দ্রুত তার বড় ভাই মাহমুদুল হাসান চলে আসেন। তিনি বলেন, বড় শিশুটি জীবিত, তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। ভাই মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় ঘটনাস্থলে এক পথচারী মহিলা এগিয়ে আসেন। তাকে বলি আপা বাচ্চাটা জীবিত আছে নাড়িটা কেটে দেন। আমি ব্লেড নিয়ে আসি। এ কথা বলে দ্রুত একটি ব্লেড নিয়ে আসি। তখন মহিলা নাড়িটা কাটতে গিয়ে দেখেন কিছু মাংসপিণ্ডসহ নাড়ি বেরিয়ে এসেছে। নাড়িটা পেঁচিয়ে দ্রুত গামছা দিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে যাই। নবজাতকের মায়ের বুক থেকে মাথা পর্যন্ত ট্রাকের চাপায় সড়কে মিশে গেছে। পেটের নিচের অংশটুকু অক্ষত আছে। ধারণ করা হয়, ট্রাকের চাপায় নবজাতকটি ভূমিষ্ঠ হয়ে পড়ে। অলৌকিকভাবে সড়কে জন্ম নেয়া সেই নবজাতক জন্ডিসে আক্রান্ত। এজন্য তাকে লাবীব হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে নবজাতকের নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) চিকিৎসা শুরু হয়েছে।

একইসঙ্গে মঙ্গলবার সকালে তার চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। লাবীব হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, শিশুটি কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (সিবিএমসি) শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে ছিল। কিন্তু জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দেয়ায় চিকিৎসক ফটোথেরাপি দেয়ার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. ওয়ায়েজ উদ্দিন ফরাজী জানান, শিশুটির চিকিৎসায় নিউনেটাল বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডের মতামত অনুযায়ী শিশুটি এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। শিশুটি জন্ডিসে আক্রান্ত হাড় ভাঙা ও রক্তস্বল্পতা রয়েছে। মেডিকেল বোর্ডের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা চলছে। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, জন্ডিসের জন্য শিশুটিকে ফটোথেরাপি দেয়া হচ্ছে। তার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর আমরা রাখছি।

বাবলুর পরিবারে সড়ক দুর্ঘটনার ট্র্যাজেডি: ফকির বাড়ির মৃত শেখ ইব্রাহিমের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও ফজলুল হক। ১৯৯৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ফজলুল হক মারা যান। মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু এর দুই ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ও শামসুল হক। ২০০৪ সালে শামসুল হক ১৩ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সর্বশেষ গত ১৬ই জুলাই শনিবার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা রত্না আক্তার রহিমা এবং এক কন্যা সানজিদা মারা যায়। নিহত জাহাঙ্গীর আলম গত দুই বছর ধরে সপরিবারে শ্বশুর হাবিবুর রহমানের জায়গায় একটি টিনের ঘরে বসবাস করে আসছিলেন। বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা আর ঝগড়া-বিবাদের কারণে বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি থাকতেন। নিহত জাহাঙ্গীরের শ্বশুর হাবিবুর রহমানের ছেলে ফারুক জানান, আমার বোন রত্না আক্তার রহিমা ও ভগ্নিপতি জাহাঙ্গীর আলম এবং ভাগ্নির সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তিনি বলেন, আমার তিন ভাগ্না-ভাগ্নিকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। তাদের সাহায্যে অনেকেই এগিয়ে আসছেন বলে আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারছি।

সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতার অর্থ অবুঝ ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যাংকে রাখার জন্য অনুরোধ জানাই। এদের জন্য যে সাহায্য সহযোগিতা আসছে তা যেন ওদের লেখাপড়া, লালন-পালনের কাজে লাগে। বাচ্চাদের আপন দাদি, দাদার সঙ্গে থাকেন না। কাজেই তাদেরকে দেখাশোনা ও লালন-পালনের জন্য দায়িত্ব নানা-নানিকে দেয়ার অনুরোধ করছি। মিরাকল বেবির দাদা বাবলু বলেন, জাহাঙ্গীরের মায়ের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি থাকছেন। নাতি নাতনীদেরও নিজের কাছে রাখতে চান। সাহায্য পাঠাচ্ছেন অনেকে: নবজাতক এবং তার দুই ভাই-বোনের সহায়তার জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থসহায়তা পাঠাচ্ছেন দানশীল মানুষ।  ‘রত্না আক্তার রহিমার নবজাতক ও অপর দুই সন্তানের সহায়তা হিসাব’ শিরোনামের অ্যাকাউন্টে  গতকাল বৃহস্পপতিবার পর্যন্ত  জমা পড়েছে ১লাখ ২৯ হাজার টাকা।

মঙ্গলবার বিকালে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান। সোমবার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হকের নির্দেশে ত্রিশাল উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সোনালী ব্যাংকের ত্রিশাল শাখায় সঞ্চয়ী ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়। ‘রত্না আক্তার রহিমার নবজাতক ও অপর দুই সন্তানের সহায়তা হিসাব’ শিরোনামে সোনালী ব্যাংকের ত্রিশাল শাখায় সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্টটির নম্বর ‘৩৩২৪১০১০২৮৭২৮’। নবজাতক ও তার দুই ভাই-বোন প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তাদের দাদা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে অ্যাকাউন্টটি পরিচালিত হবে।