হারিয়ে যাচ্ছে কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য শুকনি বিল, বটবৃক্ষ

image

You must need to login..!

Description

উবায়দুল হক,

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন চিরতরে। বিদ্রোহী এই কবির জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ ময়মনসিংহের ত্রিশাল। জীবদ্দশায় তাকে কোনো বাঁধনে বেঁধে রাখা না গেলেও কবির স্মৃতিকে ঠিকই বেঁধে রেখেছেন এ জনপদের মানুষ।

আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবির নামে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। তবে দ্রোহের কবির যে স্মৃতি ধরে রাখতে ত্রিশালে গড়ে তোলা হয়েছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে স্থান স্বল্পতার কারণে কবির স্মৃতিবিজড়িত শুকনি বিল ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একের পর এক বহুতল ভবন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের বাইরে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে কবির প্রিয় বটগাছটি।নজরুল যে শুকনি বিলের পাড়ে বটের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাতেন, করতেন সাহিত্য চর্চা; সেই বিলটি হারিয়ে যেতে দেখে আক্ষেপের শেষ নেই আবুল কাশেম ব্যাপারীর। বিচ্যুতিয়া ব্যাপারীর চতুর্থ বংশধর তিনি। ত্রিশালের নামাপাড়া গ্রামে তাদের বাড়িতেই জাইগীর থাকতেন কবি নজরুল। তিনি কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিলেন, দিয়েছিলেন জমিও। যে আশায় এসব করেছিলেন তা যেন এখন ম্লান হতে চলেছে।

হাফেজ আবুল কাশেম বলেন, এই শুকনি বিলে বসেই কবি লিখেছিলেন, “শুকনি বিলের উপরে, পাখি ঘুরে দলে দলে, ঘুরে তারা ধীরে ধীরে।” কবির স্মৃতিটা ধরে রাখা দরকার। মানুষ যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারে এই বিলের ব্যাপারে। কিন্তু সেই বিল ভড়াট করে যেন কবির স্মৃতিকেই ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। তাই এটার সংরক্ষণ প্রয়োজন।

যে বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি, সেই গাছটিই আজ সীমানা প্রাচীরের আড়ালে অযত্নে-অনাদরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অবহেলায় আবুল কাশেমের মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আরেক আন্দোলনকারী মতিউর রহমানের মুখেও হতাশার ছাপ। মতিউর রহমান বলেন, নজরুলের স্মৃতি অবহেলা করবে এমনটার জন্য তো আমরা আন্দোলন করি নাই। কিন্তু এখন ব্যতিক্রম হয়ে গেছে। বটগাছটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ফেলে দিয়েছে। অবহেলায় তা নষ্ট হচ্ছে। আমার চাওয়া, বটগাছটি ভেতরে রেখে যেন যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়।জানা গেছে, বটগাছের পাশেই শুকনি বিলে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা পায় কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে মাত্র ১৫ একর জমির ওপর নির্মিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। শুরু থেকে বটগাছের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থাকলেও ধীরে ধীরে ভবন নির্মাণের নামে গাছটি আড়াল করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সময় বটগাছটিকে বাইরে রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর গড়ে তোলে প্রশাসন। এতে নজরুলের স্মৃতিধন্য গাছটি ক্যাম্পাসের বাইরে ও ভবনের আড়ালে চলে যায়। এর আগে, সত্তরের দশকে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট পিএ নাজির কবি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত বটগাছের গুরুত্ব অনুভব করে প্রথমবারের মতো এর চারপাশে পাকা বেদি করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বটগাছটি ক্যাম্পাসের সঙ্গে যুক্ত করতে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। আর স্থান স্বল্পতার কারণে বিলের অংশেও নির্মাণ কাজ করতে হচ্ছে। তবে সীমানার বাইরে বিলের কিছু অংশ এখনো খাস রয়েছে, সেটুকু পেলে বিলটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস উপাচার্যের।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু প্রতিষ্ঠা হয়েছে নজরুলের স্মৃতিকে স্মরণ করে ধারণ করার জন্য এবং বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবার জন্যে, এ কারণে নজরুলের স্মৃতিময় এই জায়গাগুলো অবশ্যই নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে থাকা প্রয়োজন। এটি আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মৌখিক ও লিখিতভাবে জানিয়েছি। এগুলো যে জায়গায় রয়েছে সে জায়গা থেকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের কাছে আমাদের আবেদন-নিবেদন চলছে। আমরা যদি সেটি পেয়ে যাই তাহলে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নজরুলের স্মৃতিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করতে পারবো।

উপাচার্য আরও বলেন, প্রাচীরের বাইরে বিলের কিছু অংশ এখনো খাস জমি হিসেবে আছে। সেটি যদি আমরা পাই তাহলে সেটিকে আমরা জলাধার হিসেবে রাখতে পারবো এবং যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারবো।

বিষয়টি দ্রুত আমলে নেয়ার দাবি নজরুল গবেষকদের। সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কবি শামীম সিদ্দিকী বলেন, কাজী নজরুল ইসলামে কাব্য-সঙ্গীত ও সাহিত্য জীবনে ত্রিশালের পরিবেশ-প্রকৃতি জনজীবনে যুগান্তকারী ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বজায় রেখেছে। নানাবিধ কারণেই তার স্মৃতিগুলো রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ত্রিশালে অবস্থানকালে তার স্মৃতিবিজড়িত দুইটি জায়গা। যার একটি হচ্ছে তিনি যে বটগাছটির নিচে বাঁশি বাজাতেন, শুকনি বিলে ওই তরুণ বয়সে তার চিন্তা-চেতনা এবং ঐকান্তিক সময়গুলো তিনি পার করতেন সেইরকম একটি সৃষ্টি প্রেরণায় মুখরিত জায়গাগুলো দুর্ভাগ্যবশত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় নেই। আমি মনে করি, আমাদের সকলের উচিত এই স্মৃতিগুলোকে সংরক্ষণের জন্য কীভাবে যথাযথ ও কার্যকর সমন্বয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটি খুঁজে বের করা।

প্রধান সম্পাদকঃ
মতিউল আলম

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ
মাকসুদা আক্তার