You must need to login..!
Description
ড. মো. মনছুর আলম
সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানব জীবন ও নদ-নদীর সাদৃশ্য বিদ্যমান। মানব সভ্যতাগুলো গড়ে উঠার পেছনে নদীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীকে কেন্দ্র করে মানব জীবনের বিচিত্রলীলা উদ্ভাসিত হয়েছে। নদীর রূপ-রস বৈচিত্র্যতার মত মানুষের জীবনেও লেগেছে নানা রূপের ছোঁয়া এসেছে নানা পরিবর্তন। নদী কখনও হয়েছে তার স্নেহময়ী, কল্যাণময়ী আবার কখনও হয়েছে রদ্ররূপী, অনিষ্টকারী। নদী-মানুষের এই বৈচিত্র্যময় উত্থান-পতন, ভাঙা- গড়ার রূপকে চিত্রিত করে আসছে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকগণ।
এখানে দেশ-ভাষা মুখ্য বিষয় নয়। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে ও ভিন্ন ভিন্ন ভাষাায় লিখিত সাহিত্যের রূপকল্পে নদীর বহুমাত্রিক চিত্র আত্মপ্রকাশ ঘটছে এবং ঘটবে। প্রাচীন পৌরাণিক মহাভারত-রামায়ণ, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন,বাইবেল, গীতা, সংহিতা সব গ্রন্থেই নদ-নদীর বর্ণনা মেলে। এমনকি স্বর্গ-মর্তের নদীর কথাও পাওয়া যায়। এছাড়া আদি ইলিয়াড-ওডিসি, ধ্রুপদী সাহিত্য কিংবা মধ্যযুগে ফেরদৌসির শাহানামায় নদী মানব জীবনের সাথে একীভূত। নদীকেন্দ্রিক প্রাচীন সভ্যতাগুলোর সাথে সাহিত্যের আদি নিদর্শনে নদী তার গতিময়তায় কবিতা-গানে প্রাণ দান করেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বীজতলা তৈরিতে নদীর অবদান অসামান্য। সংগত কারণেই প্রত্যেক কবি-সাহিত্যিকের লেখনীতে কোনো না কোনোভাবে উঠে এসেছে নদীকথন।
কবি-সাহিত্যিকের কাছে নদী যেমন ধরা দিয়েছে কবিতার ভাব-রূপ-রস আর সাহিত্য বুননে; তেমনি নদীর পানিপ্রবাহ, স্রোতধারা, স্রোতের কুলুকুলু ছন্দ, চলার ভঙ্গিমা, নদী সম্পদ, সর্বোপরি নদীপাড়ের বাসিন্দাদের বিচিত্র জীবন উঠে এসেছে সাহিত্যের চিত্রকল্পে। উঠে এসেছে নদীর উপমা, প্রতীক আর চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প। তবে কাব্যসাহিত্যের চেয়ে নদী ঔপন্যাসে এসেছে বিস্তৃত পরিসরে। ঔপন্যাসেই নদী ও জীবনকে রূপায়িত হতে দেখা গেছে বেশি। আমাদের আলোচ্য বিষয় ইছামতি নদী ও বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রশ্ন হচ্ছে ‘ইছামতি নদী’ নামে বাংলাদেশ-ভারত মিলে সর্বমোট ১২টি নদীর সন্ধান পাওয়া যায়। তাহলে কোন ইছামতি নদীর সাথে বিশ্ব কবির সখ্যতা, মিতালি গড়ে উঠেছে। শুধু সখ্যতা বললে ভুল হবে; কারণ রবীন্দ্র সাহিত্যের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে আছে ‘পাবনা ইছামতি নদীথ। তাই এই প্রবন্ধে পাবনা ইছামতি নদীর সাথে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সখ্যতা, নদী ভাবনা, নদী পাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখ, নদীর বুকে নৌকা-বজরা ভাসিয়ে দিনের পর দিন লেখনী ধারণ এমন কি নদী তীরের বসিন্দাদের সাথে আত্মিক বন্ধন আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
পাবনা ইছামতি নদীর দৈর্ঘ্য ৮৪ কিলোমিটার। প্রস্থ সর্বনিম্ন ১০০ মিটার এবং সর্বোচ্চ ১৪০ মিটার অর্থাৎ গড় প্রস্থ ১২০ মিটার। গভীরতা শহরাংশে পদ্মা হতে তৈলকুপি-জগনাথপুর বাঁধ পর্যন্ত ০২ মিটার; বর্তমানে এই অংশটুকু মরা নদী। অপর অংশ অর্থাৎ তৈলকুপি-জগনাথপুর বাঁধ থেকে পতিতস্থল বেড়া হুরাসাগর পর্যন্ত ৪ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত অর্থাৎ গড় গভীরতা ০৫ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন ৪৫০ বর্গকিলোমিটার। নদীটি মৌসুমি প্রকৃতির এবং ধরন বা বৈশিষ্ট্য সর্পিল আকার। ইছামতি নদী বন্যাপ্রবণ হলেও জোয়ার-ভাটার কোনো প্রভাব নেই। প্রবাহিত এলাকা পাবনা সদর উপজেলা, আটঘোরিয়া, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলাসমূহ। ইছামতি নদী ছিল পদ্মার সাথে যমুনা নদীর সংযোগ স্থাপন ও যোগাযোগের অন্যতম নৌপথ। এছাড়া মধ্যযুগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসায়-বাণিজ্য, নৌ-যোগাযোগ ও নৌবহর চলাচলের অন্যতম পথ ছিল পাবনা ইছামতি নদী। (ড. মো. মনছুর আলম, ইছামতি নদীর পূর্বাপর, পৃ. ৫৯-৬০)। ইছামতি নদী দিয়ে অনেক অনেক সওদাগরী নৌকা, গয়নার নৌকা, বেদে বহর চলাচল করত। অত্যন্ত শান্ত সুশ্রী ইছামতি নদীর বক্ষে এক সময় শত শত পালতোলা নৌকা চলত। এছাড়া ভেলা, ডিঙি, বজরা, লঞ্চ, স্টিমার অবাধে চলাচল করত এই নদী দিয়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক স্মৃতি জড়িত এই নদীর সাথে। তিনি তাঁর জমিদারি দেখাশোনা করতে বজরা ভাসিয়ে পদ্মা নদী হতে ইছামতি নদীর বক্ষে প্রবেশ করতেন। ইছামতি নদীর সৌন্দর্য, ছোট ছোট ঢেউ, নদী পাড়ের ঘাসফুল-কাশফুল সবুজ-শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতি, নব বধূদের জলকেলি, শিশু-কিশোরদের দাপাদাপি সবই বজরায় বসে উপভোগ করতেন। ইছামতি নদীর এই রূপে-সৌন্দর্যে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে, তিনি মনের অজান্তেই গেয়ে চলেছেন- জলের উপর ঝলোমলো টুকরো আলোর রাশি ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন, হাততালি আর হাসি। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ইচ্ছামতী’, পৃ. ৩২৯)।
বিশ্বকবি ইছামতি নদী হয়ে শাহজাদপুর জমিদারি জমিদারিতে যাতায়াত করতেন। আবার কখনও কখনও শাহজাদপুর হতে নওগাঁ পতিসর জমিদারিতেও যেতন। তাই শুধু ইছামতি নদীই নয় তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় পাবনা অঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদী এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে ৩ আষাঢ় ১২৯৮ (১৬ জুন ১৮৯১) সালে শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি থেকে ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রে এ এলাকর নদী এবং প্রাকৃতির সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া ২৩ জুন ১৮৯১ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ এলাকার নদী ও প্রাকৃতির সৌন্দর্য তুলে ধরে ইন্দিরা দেবীবে লেখেন, “আজকাল দুপুর বেলাটা বেশ লাগে। রৌদ্রে চারিদিক বেশ নিঃঝুম হয়ে থাকে-মনটা ভারি উড়ু উড়ু করে, বই হাতে নিয়ে আর পড়তে ইচ্ছে করে না। তীরে যেখানে নৌকা বাঁধা আছে সেইখান থেকে এ রকম ঘাসের গন্ধ এবং থেকে থেকে পৃথিবীর একটা গরম ভাপ গায়ের উপরে এসে লাগতে থাকে- মনে হয় যেন এই জীবন্ত উত্তপ্ত ধরণী আমার খুব নিকট থেকে নিঃশ্বাস ফেলছে- বোধ করি আমারো নিঃশ্বাস তার গায়ে গিয়ে লাগছে।
ছোট ছোট ধানের গাছগুলো বাতাসে ক্রমগত কাঁপছে- পাতিহাঁস জলের মধ্যে নেবে ক্রমাগত মাথা ডুবাচ্ছে এবং চঞ্চু দিয়ে পিঠের পালক সাফ করছে। আর কোন শব্দ নেই, কেবল জলের বেগে বোটটা যখন ধীরে ধীরে
বেঁকতে থাকে তখন কাছিটা এবং বোটের সিঁড়িটা এক রকম করুণ মৃদু শব্দ করতে থাকে। অনতিদূরে একটা খেয়াঘাট আছে। বটগাছের তলায় নানাবিধলোক জড়ো হয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে- নৌকা আসামাত্রই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ছে-অনেক্ষণ ধরে এই নৌকা পারপার দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ওপারে হাট, তাই খেয়া নৌকায় এতো ভীড়। কেউবা ঘাসের বোঝা, কেউবা চুপড়ি, কেউবা একটা বস্তা কাঁধে কথরে হাটে যাচ্ছে এবং হাট থেকে ফিরে আসছে-ছোট নদীটি এবং এবং দুই পারের দুই ছোট গ্রামের মধ্যে নিস্তব্ধ দুপুরবেলায় এই একটুখানি কাজকর্ম, মনুষ্যজীবনের
এই একটুখানি স্রোত, অতি ধীরে ধীরে চলছে।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিন্নপত্র)। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্রথ-এর পরতে পরতে পাবনা ইছামতি নদীর সৌন্দর্য ও ভ্রমণের চমকপ্রদ সব বর্ণনা উঠে এসেছে।
এছাড়া ‘চৈতালী’ কাব্যে ‘ইছামতী নদী ‘শুশ্রুষা’, ‘আশিস গ্রন্থ ও ‘বিদায়’ তাঁর রচিত অনবদ্য ৪ টি সনেট। ইছামতি নদীর সৌন্দর্যই শুধু নয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নদী পাড়ের সৌন্দর্য যে তাৃকে মোহিত করেছিল তার প্রমাণ মেলে তাঁর রচিত ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যে ‘ইচ্ছামতী’ কবিতায়। তিনি তাঁর মনের ব্যাকুলতা তুলে ধরেছেন এভাবে-
যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি
আমি তবে এক্ষুণি হই ইচ্ছামতী নদী।
রইবে আমার দখিন ধারে সূর্য ওঠার পার,
বাঁয়ের ধারে সন্ধ্যেবেলায় নামবে অন্ধকার,
আমি কইব মনের কথা দুই পারেরই সাথে-
আধেক কথা দিনের বেলায়, আধেক কথা রাতে।।- (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইচ্ছামতী)।
ইছামতি নদীর শান্ত জলধারা, শিশু-কিশোরদের নদীর পানিতে দাপাদাপি,
স্বাদু পানির মাছ, মাছ ধরা, মাছ ধরার কৌশল, বর্ষার সময় দু’কূল ছাপিয়ে
নদীর পানি বিলিয়ে দেয়া, সর্বোপরি নদীকে ঘিরে নদী পাড়ের মানুষের নানা
কর্মপ্রবাহ, কর্মচাঞ্চল্য বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর একদম কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি ইছামতি নদীর প্রবাহধারা ও নদী পাড়ের জীবনচিত্র ফুটে তুলেছেন তাঁর ‘ছিন্নপত্রেথর চরণে চরণে। তিনি বলেন, “ইছামতী মানুষ-ঘেঁষা নদী, তার শান্ত জলপ্রবাহের সঙ্গে মানুষের কর্মপ্রবাহের স্রোত মিশে যাচ্ছে। সে ছেলেদের মাছ ধরবার বা মেয়েদের স্নান করার নদী। স্নানের সময় মেয়েরা যে-সমস্ত গল্প নিয়ে আসে সেগুলো এই নদীটির হাস্যময় কলধ্বনির সঙ্গে একসুরে মিলে যায়। আশ্বিন মাসে মেনকার ঘরের পার্বতী যেমন কৈলাসশিখর ছেড়ে একবার তার বাপের বাড়ি দেখে শুেেনে যান, ইছামতী তেমনি সম্বৎসর অদর্শন থেকে বর্ষার কয়েক মাস আনন্দহাস্য করতে করতে তার আত্মীয় লোকালয়গুলোর তত্ত্ব নিতে আসে। তার পরে ঘাটে ঘাটে মেয়েদের কাছে প্রত্যেক গ্রামের সমস্ত নূতন খবর শুনে নিয়ে, তাদের সঙ্গে মাখামাখি সখিত্ব করে আবার চলে যায়।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিন্নপত্র।)
ইছামতি নদীই শুধু নয় নদী পাড়ের মানুষের জীবন প্রণালি-কর্মধারা, নদী পাড়ের বনরাজি, গাঢ় সবুজের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, ধান খেত, পাট খেত, নদী পাড়ের প্রকৃতি-জীববৈচিত্র্য, ঘাসবন-কাশবন, মনমুগ্ধকর গ্রাম,
গ্রামগুলোর বুক চিরে প্রবাহিত অাঁকাবাঁকা নদী পথ; যেন গ্রামীণ মোঠেপথ দিয়ে হাঁটছি আর হাঁটছি, কোনো ক্লান্তি নেই শ্রান্তি নেই- আছে শুধু পর্বতসম ভালোলাগা-ভালোবাসা। কর্তব্যের তাগিদে নয় সেই ভালোবাসার তাগিদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বার বার ছুটে এসেছেন ইছামতির বক্ষে। ইছামতির নদীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কতটা নিবিড়
সম্পর্ক ছিল তা তাঁর বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়। তিনি ‘ছিন্নপত্রেথ উল্লেখ করেছেন এভাবে, “ইছামতীর ভিতরে ঢোকা গেল। কী সুন্দর উজ্জ্বল দিনটি হয়েছিল। ছোট্ট নদীটির দুই ধারের বনগুলো এবং গাঢ় সবুজ শস্যক্ষেত্র রৌদ্রে প্রফুল্ল হয়ে রয়েছে। বাতাসটি বেশ মিষ্টি লাগছে-বিছানার উপর জানালার কাছে গোটা পাঁচ-ছয় বালিশ উঁচু করে রাজার মত বসে রইলুম, চোখের উপর কে যেন স্বপ্ন মাখিয়ে দিয়েছে- জেলেরা মাছ ধরছে, মেয়েরা কাপড় কাচছে, ছেলেরা জলের মধ্যে পড়ে তোলপাড় করছে, গরুগুলো চরছে, জলমগ্ন ধানের ক্ষেতে বক বসে রয়েছে, সমস্ত ছবির মত দেখাচ্ছে। …. এই আঁকাবাঁকা নদীর ভিতর দিয়ে চলেছি। এই ছোট খামখেয়ালি বর্ষাকালের নদীটি- এই যে দুই ধারে সবুজ ঢালু ঘাট, দীর্ঘ
ঘন কাশবন, পাটের খেত, আখের খেত আর সারি সারি গ্রাম- এ যেন একই কবিতার কয়েকটা লাইন। আমি বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছি এবং বারবারই ভালো লাগছে।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিন্নপত্র)।
ইছামতি পাড়ের বাসিন্দাদের জন্য বিশ্ব কবি অন্তর থেকে শুভকামনা করেছেন। তাদের ঘর যেন সুখ শান্তিতে ভরে থাকে, শস্য ভাণ্ডরে পরিপূর্ণ থাকে, উৎসব-আনন্দ-উল্লাসে সারাটা জীবন যেন কেটে যায়-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সে বাসনাই ছিল। এ ধরার বুক হতে তাঁর প্রস্থানের পরও যেন এ ধারা অব্যাহত থাকে তাঁর ‘চৈতালী’ কাব্য গ্রন্থের ‘ইছামতী নদী’ কাব্যে এই
আকুতিই ফুটে উঠেছে। তাঁর ভাষায়-
অয়ি তন্বী ইছামতী তব তীরে তীরে
শান্তি চিরকাল থাক কুটিরে কুটিরে
শস্যে পূর্ণ হোক ক্ষেত্র তব তটদেশে
বর্ষে বর্ষে বরষায় আনন্দতি বেশে। — —– —- যখন রব না আমি, রবে না এ গান,
তখনো ধরার বক্ষে সঞ্চারিয়া প্রাণ,
তোমার আনন্দগাথা এ বঙ্গে, পার্বতী
বর্ষে বর্ষে বাজিবেক অয়ি ইছামতী।- (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চৈতালী,
‘ইছামতী নদী’)। শুধু নদ-নদীই নয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এ অঞ্চলের ঘি, দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য পেয়ে বসেছিল। তিনি শিলাইদহ হতে পদ্মা নদী থেকে ইছামতি নদী হয়ে সোজা পথে সোনাতলা বড় জোলা দিয়ে বলেশ্বর নদীতে ঢুকতেন। অতঃপর বলেশ্বর নদী থেকে সোজা বড়াল নদী ধরে ফুলজোড় নদী দিয়ে শাহজাদপুর কাছারি বাড়িতে যেতেন। যাত্রাপথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোনাতলা বাজার থেকে দুগ্ধজাত খাদ্য যেমন ঘি, মিষ্টি, দই কিনেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।(ড. মো. মনছুর আলম, ইছামতি নদীর পূর্বাপর, পৃ. ৪৯-৫০)। এ অঞ্চলের দুধ-দই-ঘি শুধু নিজের জন্য নয়, মঝে মধ্যে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকেও পাঠিয়েছেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তিনি লেখেন, “আচ্ছা আমি যে তোমাকে এই শাহজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখন মারা ঘেত্ত, সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্বন্ধে কোন রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বল দেখি?’ (চিঠিপত্র, ১ম খণ্ড, বিশ্বভারতী, পত্র নং-৮)।
পাবনা জেলার নদ-নদী, প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাবনার মানুষ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারকে এতোটাই আকৃষ্ট করেছিল যে, যার প্রতিদান স্বরূপ তাঁরা পাবনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। পাবনার চাটমোহরের প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর ভাই ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরীর সাথে বিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন প্রতিভা দেবীকে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আপন ভাতিজি ইন্দ্রিরা দেবীকে বিয়ে দেন প্রমথ চৌধুরীর সাথে। পাবনা রিভারাইন পিপল-এর পক্ষ থেকে পাবনার আত্মীয়, ইছামতি নদীর পরমাত্মীয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
[ লেখক : প্রাবন্ধিক ও নদী গবেষক; সভাপতি- রিভারাইন পিপল, পাবনা।]