You must need to login..!
Description
দিলরুবা আহমেদ
সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কথা বলা আছে। পরিবেশ হলো এমন একটি পরিপার্শ্বিক অবস্থা যার মধ্য দিয়ে উদ্ভিদ, মানুষ জীবন যাপন করে এবং সেই সব দৃশ্য ও অদৃশ্য উপাদান যা মানুষের জীবন ও জীবিকার উপড় প্রভাব বিস্তার করে। পরিবেশের উপদানগুলো যেমন জল, বায়ু, আলো, মাটি ও জীব এর যদি কোন কারণে কাঙ্খিতমাত্রা বিনষ্ট হয় বা স্বাভাবিকতা হারায় তখন তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। তবে ইউনেস্কোর দৃষ্টিতে পৃথিবী নামক গ্রহের প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা যা আমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনের ওপর ক্ষতির প্রভাব বিস্তার করে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। বিভিন্ন ধরণের দূষণের মধ্যে শব্দ দূষণ অন্যতম। শব্দের উৎস থেকে উৎপন্ন শব্দ শক্তি তরঙ্গের আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা আমাদের কানের ভিতরে প্রবেশ করলে আমাদের মস্তিস্কে এক বিশেষ অনুভুতির সৃষ্টি করে ফলে আমারা শব্দ শুনতে পাই। শব্দ যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম তবে নির্ধারিত
মাত্রায় অতিরিক্ত শব্দই শব্দ দূষণ যা প্রাণীর নার্ভাস সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। মানুষের শ্রবণসীমা ২০ থেকে ২০০০০ হার্জ পর্যন্ত, অনেক প্রাণী ২০-২০০০০ হার্জের উপরে বা নীচে উৎপাদিত শব্দ শুনতে পায় যেমন: ২০০০০ হার্জের উপড়ে শুনতে পায় বাদুর, ২০ হার্জের কমে শুনতে পায় হাতি।
শব্দ দূষণকে কেন গুরুত্ব দেয়া উচিত-
মানুষের শ্রবণ শক্তি হ্রাস ও স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, অনিদ্রা, স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপসহ নানানরকম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী মা, গাড়ি চালক, ট্রাফিক পুলিশসহ জরুরী পেশায় নিয়োজিতদের নানা রকমের স্বাস্থ্য ঝুকি তৈরী হয়। এমনকি সকল ধরনের উদ্ভিদ মানুষের মতোই সংবেদনশীল। এর দ্রুত বৃদ্ধি জন্য একটি শান্ত নীরব পরিবেশ প্রয়োজন।
দীর্ঘ দিন উচ্চ শব্দে থাকলে শস্যের উৎপাদন ও মান কমে যায়। শব্দ দূষণ মানুষের মতো প্রাণিদের নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ করে। অতিরিক্ত শব্দ পশুদের স্বাভাবিক এবং নির্ধারিত চলাচলে ও প্রজনন ক্ষমতা উপড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি নদীতে চলমান জলযানের উচ্চ শব্দে বিভিন্ন মাছের উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষমতা কমে তা ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে।
শব্দ দূষণের উল্লেখযোগ্য কারণ-
দ্রুত নগরায়ন ও উন্নয়ন কাজ, যান্ত্রিক যানবাহন বৃদ্ধি, যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত হর্ণের ব্যবহার, উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী জেনারেটর ব্যবহার, অপরিকল্পিত শিল্প কল-কারখানা, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রচারনার কাজে ব্যবহৃত মাইক, সাউন্ড বক্স, আতশবাজি ব্যবহার, বিস্ফোরণের শব্দ, বিমান, ট্রেন, জল যানের শব্দ ইত্যাদি।
শব্দ দূষণ রোধে করণীয়-
প্রযুক্তিগত উপায়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ: বিভিন্ন কলকারখানা বা শিল্পসংস্থার পুরানো আমলের উচ্চ শব্দ বা কর্কশ শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রের প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটিয়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা যায়। অনেকক্ষেত্রে যেসব যন্ত্রপাতি থেকে অবাঞ্ছিত শব্দ উৎপান্ন হয় সেসব যন্ত্রপাতির ওপর শব্দ নিয়ন্ত্রণকারী (কেনোপি) আচ্ছাদনের ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেসব মানুষ যেখানে ৪০ ডেসিবেলের বেশি শব্দের প্রভার রয়েছে সেখানে কাজ করেন, তাদের জন্য শব্দ প্রতিরোধক ইয়ার প্লাগ,ক্যানাল কাপ এবং ইয়ার মাফ ব্যবহারের ব্যবস্থা করা যায় ফলে শব্দ দূষণ
ওইসব মানুষের ওপর তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করে না।
যেসব শিল্পকারখানায় প্রচন্ড শব্দ উৎপন্ন হয় সেখানে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের জন্য শব্দ
প্রতিরোধী অঞ্চল তৈরি করা প্রয়োজন।
গাড়ির হর্ণের তীব্র আওয়াজ প্রতিরোধ করার জন্য সাইলেন্সার লাগাতে হবে।
পরিবেশগত উপায়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ:
গাছপালা শব্দ শোষণ করতে পারে তাই শহরাঞ্চল রাস্তার দু ধারে গাছপালা লাগিয়ে শব্দদূষণ রোধ করা
হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তেতুল, বট, অশোক, নিম, নারিকেল, দেবদারু প্রভৃতি উদ্ভিদ বেশি
মাত্রায় শব্দ শোষণ করে।
বর্তমানে শহর অঞ্চলের অনেক বাড়িতে ঘরের প্রাচীর এবং ছাদ শব্দ নিরোধক দ্রব্য দ্বারা আচ্ছাদিত
করা হয় এর ফলে শব্দ দূষণ কিছুটা প্রতিরোধ করা যায়।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় (ব্যক্তিগত) :
আবাসিক এলাকা শব্দদূষণ মুক্ত করা যেমন: ইট/পাথর ভাঙ্গানোর মেশিন আবাসিক এলাকায়
বিধিমালার আলোকে ব্যবহার করা।
হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা ও অফিস পাড়া-সরকার ঘোষিত নীরব এলাকা।
নীরব এলাকা হতে সকল ধরণের শব্দ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অপসারণ ও অযথা হর্ণ বাজানো পরিহার
করা।
যেকোন ধরণের পণ্য /ব্যবসা /সেবা /ঘোষণা/ প্রচারনার জন্য মাইকের ব্যবহার সীমিত করা।
সামাজকি, রাজনতৈকি, র্ধমীয় সমাবশেে নর্ধিারতি শব্দ মাত্রায় মাইক ব্যাবহার নিশ্চিত করা।
উচ্চ শব্দে হেড ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় (প্রাতিষ্ঠানিক) :
বিদ্যমান আমদানী নীতি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবলের উচ্চ হর্ণ আমদানী বন্ধ করা।
শব্দদূষণকারী ত্রুটিপূর্ণ বা মেয়াদ উত্তীর্ণ যান চলাচল বন্ধ এবং অনুমোদনহীন মোটরযান ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
হর্ণ না বাজানোর বিষয়ে ড্রাইভারদের মনঃস্তাত্বিক পরিবর্তন আনয়ন।
“শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা” ২০০৬ বাস্তবায়নে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা।
রাইড শেয়ারিং সার্ভিস এর আওতায় কর্মরত ড্রাইভারদের সচেতনতা বৃদ্ধি।
শব্দদূষণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়ে নাগরিক সমাজকে সচেতন করা, বিভিন্ন প্রচারণাসহ সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা।
সংশ্লিষ্ট আইন/বিধিমালা/নীতিমালা-
শব্দ দূষণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী নীরব এলাক, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকার ক্যাটাগরি অনুযায়ী দিন ও রাতের জন্য আলাদাভাবে শব্দের মানমাত্রা বা স্ট্যান্ডার্ড লেভেল নির্ধারণ করা আছে। নীরব এলাকা দিনে ৫০ ডেসিবেল ও রাতে ৪০ ডেসিবেল। শিল্প এলাকায় সবচেয়ে বেশি ৭৫ ডেসিবেল মাত্রায় শব্দ অনুমোদন যোগ্য। এই বিধিমালা অনুযায়ী প্রথমবার শব্দদূষণের অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ১ (এক) মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ড আর দ্বিতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ৬ (ছয়) মাসের কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার বা উভয় দন্ডের দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়া আরো যে সকল আইন বিধি ধারা শব্দদূষণকে রোধ করা যায় তা হলো-বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮, আমদানী নীতি আদেশ ২০১৫-২০১৮, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, মোটরযান আইন ১৯৮৩, ইমারত নির্মান বিধিমালা ২০০৮, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর, ময়মনসিংহ বিভাগের গৃহীত কার্যক্রম:
শব্দ দূষণ একটি নীরব ঘাতক। এটি প্রতিরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর “শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদায়িত্বমূলক প্রকল্প” নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যা সারা দেশব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনের প্রয়োগের শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোণা জেলায় আন্তজার্তিক শব্দ সচেতনতা দিবস পালন, জনসচেতনতা মূলক সভা/প্রশিক্ষণ/ কর্মমালার আয়োজন করছে এবং নিয়মিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ বিভাগে ২০২৩ সালে মোট ১১টি শব্দ দূষণ সচেতনতামূলক কর্মসূচী আয়োজন করেছে। এসকল কর্মসূচী মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যেমন: নির্মাণ শ্রমিক, কলকারখানার শ্রমিক, চালক, সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারী, শিক্ষার্থী, ইমাম, সাংবাদিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া ২০২২ সালে ৩১টি মোবাইল কোর্টে ১৩০ টি মামলা এবং ১,৬৫,৫০০/- টাকা জরিমানা ধার্য ও আদায় করা হয়েছে এবং ২০২৩ সালে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১১১টি মোবাইল কোর্টেল মাধ্যেমে ৩৯২টি মামলা ও ৩,৯৭,৩০০/- টাকা জরিমানা ধার্য ও আদায় করা হয়েছে।
মূলত আইনের প্রয়োগই শুধু নয় সকলের সচেতনতা ভীষণ জরুরী এই শব্দদূষণ কে রুখতে। তাই সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ঐক্যবদ্ধ কর্ম প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জনসচেতনতার মাধ্যমেই সম্ভব শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব সুখী সমৃদ্ধ সোনারবাংলা গড়ে তোলা।
লেখক: দিলরুবা আহমেদ, পরিচালক (উপসচিব), পরিবেশ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, ময়মনসিংহ।