ভেজালমুক্ত খাদ্যপ্রাপ্তি ও ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা

image

You must need to login..!

Description

 

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান

খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, পরিবহন ও মূল্য নিয়ে আলোচনা এসময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বলা হচ্ছে ব্যবসায়ীরা অবৈধ মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি
করে মূল্য বাড়াচ্ছেন। ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রাণান্ত চেষ্টা, বাণিজ্য মন্ত্রীর তৎপরতা, কোন কিছুতেই খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের এ নিয়ে বিস্তর
অভিযোগ। বাধ্য হয়ে সরকার ২০২৩ সালে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর,পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন বা এতদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রম
প্রতিরোধকল্পে এ সংক্রান্ত ১৯৫৬ ও ১৯৭৯ সালের আইন রহিত করে নতুন আইন প্রণয়ন করে।
আইনে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ ও জরিমানা দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ৩ ধারায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন বা বিপণন সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। ক)
যদি কোন ব্যক্তি কোনো অনুমোদিত জাতের খাদ্যশস্য হতে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যকে উক্তরূপ জাতের উপজাত হিসেবে উল্লেখ না করে ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বিপণন করেন, খ) খাদ্যদ্রব্যের মধ্য হতে কোনো স্বাভাবিক উপাদানকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অপসারণ বা পরিবর্তন করে উৎপাদন বা বিপণন করেন, গ) খাদ্যদ্রব্যের সাথে মানব
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কৃত্রিম উপাদান মিশিয়ে উৎপাদন বা বিপণন করেন, ঘ) খাদ্যবিভাগ কর্তৃক ইস্যুকৃত খাদ্যশস্য ব্যবসার লাইসেন্স ব্যতীত বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স দ্বারা
ব্যবসা পরিচালনা বা লাইসেন্সে উল্লেখিত পরিমাণের অধিক পরিমাণে খাদ্যশস্য বিপণন করেন, তাহলে দুই বছরের কারাদণ্ড ও অনুর্ধ্ব দশ লাখ টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত
হবেন।
আইনের ৪ ধারায় মজুত সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি সরকার কর্তৃক, সময় সময়, প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত পরিমাণের অধিক পরিমাণ
খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে বা মজুত সংক্রান্ত সরকারের কোন নির্দেশনা অমান্য করলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনুর্ধ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের ৫ ধারায় সরবরাহ সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি  ক) পুরাতন খাদ্যদ্রব্য পলিশিং বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশিয়ে, খ) সরকার
কর্তৃক খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহকালে সরকারি গুদামে রক্ষিত খাদ্যদ্রব্য বৈধ বা অবৈধভাবে সংগ্রহ করে, গ) দেশে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য বা, ঘ) সরকারি
গুদামের পুরাতন বা বিতরণকৃত সিল বা বিতরণ করা হয়েছে এরূপ চিহ্নযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ভর্তি বস্তা বা ব্যাগ, ঙ) আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণগত বা গুণগত

পরিবর্তন করে বা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারি গুদামে সরবরাহ করলে দুই বছরের কারাদণ্ড ও দশ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনের ৬ ধারায় বিতরণ, স্থানান্তর, ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি খাদ্য বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত বিতরণকৃত সিল বা বিতরণ করা হয়েছে এরূপ চিহ্নযুক্ত সিল ব্যতীত সরকারি গুদামের খাদ্যপণ্য ভর্তি বস্তা বা ব্যাগ বিতরণ, স্থানান্তর, ক্রয়-বিক্রয় করলে দুই বছরের কারাদণ্ড ও দশ লাখ টাকা অর্থদন্ড
বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের ৭ ধারায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন
সম্পর্কিত কোন মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি তৈরি, মুদ্রণ, প্রকাশ, প্রচার বা বিতরণ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১৫ লাখ টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনের ৮ ধারায় কর্তব্য পালনে বিরত থাকা বা কর্তব্য পালনে বাধা প্রদানের দণ্ড আলোচিত হয়েছে। শ্রমিক, কর্মচারী, ঠিকাদার, মিল মালিক, ডিলার বা সরকার কর্তৃক  নিযুক্ত কোন ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য মজুত, উৎপাদন, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ,বিপণন বা এ সংক্রান্ত কোন কাজে বিরত থাকলে বা সম্পৃক্ত কোন ব্যক্তিকে বিরত থাকতে প্ররোচিত বা বাধ্য করলে বা তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করলে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোন কোম্পানি এ আইনের অধীন কোন অপরাধ করলে বা অপরাধে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। আইনের ১০ ধারায় প্রবেশ ও পরিদর্শনের কথা বলা হয়েছে। খাদ্য পরিদর্শক যে কোন
সময় যে কোন গুদাম, মিল, কারখানা বা খাদ্যশস্য রয়েছে এমন স্থানে প্রবেশ ও পরিদর্শন করতে পারবেন। খাদ্য পরিদর্শকের যদি বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ থাকে
যে, কোন ব্যক্তি কর্তৃক এ আইনের অধীন বিষয়ে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলে সংশ্লিষ্ট গুদাম, মিল, নৌযান, যানবাহন, কোস্টার, লাইটার, ঘর,
কারখানা বা মজুতের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্থান সিলগালা করতে পারবেন, খাদ্যদ্রব্য ও অপরাধ সংগঠনে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি জব্দ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তালিকা
তৈরি করে মালিক ও দুইজন স্বাক্ষীর স্বাক্ষরসহ নিজে স্বাক্ষর করবেন।এ ক্ষেত্রে পরিদর্শক অধিভুক্ত এলাকার থানায় মামলা করবেন, জব্দকৃত খাদ্যদ্রব্য বা নমুনা যাতায়াতের সময়
ব্যতীত ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপন করবেন। এ আইনের অধীন অপরাধসমূহে আসামি কোর্ট জামিন পাবেন।
এ আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসন ও জেলা খাদ্য বিভাগ ময়মনসিংহ এর আয়োজনে, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সভা
অনুষ্ঠিত হয়। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন মোঃ আব্দুল কাদের, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক,
ময়মনসিংহ, মোঃ মাসুদুর রহমান, অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর,ময়মনসিংহ, এস .এম. আসাদুজ্জামান যুগ্ম পরিচালক, জাতীয় নিরাপত্তা
গোয়েন্দা সংস্থা ময়মনসিংহ, এ.এস.এম. হাসান সরকার, জেলা বাজার কর্মকর্তা, মোঃ খলিলুর রহমান, সভাপতি, জেলা মিল মালিক সমিতি, এরশাদুর রহমান, সাধারণ
সম্পাদক, জেলা মিল মালিক সমিতি। এছাড়াও জেলার প্রতিটি উপজেলার মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণ অংশগ্রহণ করেন।
সভায় জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ আব্দুল কাদের বলেন, দেশের চাল উৎপাদনকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, একই জাতের ধান হতে
উৎপাদিত চাল বিভিন্ন নামে ও দামে বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তাগণ ন্যায্য মূল্যে পছন্দমত জাতের ধান, চাল কিনতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ধান থেকে চাল উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিপণন ও বিতরণ কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনয়নে (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন
২০২৩ যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট মিল মালিক, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীগণকে আহ্বান জানান। তিনি আরো জানান, পরিপত্র অনুযায়ী চালের
উৎপাদনকারী মিলারগণ গুদাম হতে বাণিজ্যিক কাজে চাল সরবরাহের প্রাক্কালে চালের বস্তার উপর উৎপাদনকারী মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদন তারিখ,
মিল গেট মূল্য এবং ধান/চালের জাত উল্লেখ করতে হবে। বস্তার উপর উল্লেখিত তথ্যাদি কালি দ্বারা হাত দিয়ে লেখা যাবে না। উৎপাদনকারী সকল মিল মালিক
(অটো/হাস্কিং) কর্তৃক সরবরাহকৃত সকল প্রকার চালের বস্তা/প্যাকেটের (৫০/২৫/১০/৫/২/১ কেজি ইত্যাদি) উপর উল্লেখিত তথ্যাদি মুদ্রিত করতে হবে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে।
সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে খাদ্যে ভেজাল করা অনিয়ম করা, আইন ও নৈতিকতা ও নৈতিকতা বিরুদ্ধ কাজ। রোজাতে সংযম থাকার কথা বেশি, কিন্তু
রোজা এলেই খাদ্যদ্রব্য নিয়ে অনিয়ম বেশি হয়। দেশ-বিদেশে রাষ্ট্রের ও ধর্মের মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আইন করে বা প্রত্যেক ব্যবসায়ীর পেছনে পুলিশ নিযুক্ত করে এ
অপরাধ থেকে বিরত রাখা যাবে না। আমরা, আপনারা যে দেশ বিদেশে যাই, সেখানে কোথাও খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো বা অতিরিক্ত দাম রাখার কোন উদাহারণ দেখেছেন?
নিজে অপরাধ করে অন্যকে দোষারোপ করার মানসিকতা ছাড়তে হবে। মনে রাখবেন,যে অপরাধ আজ আপনি অনায়াসে করে যাচ্ছেন, সে অপরাধ একদিন আপনার ঘরে
হানা দিতে পারে। খাদ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা আসুক, আজকের দিনে এ প্রত্যাশা।

লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ

প্রধান সম্পাদকঃ
মতিউল আলম

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ
মাকসুদা আক্তার