কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ভাঙার তথ্যটি সঠিক নয়ঃ অপপ্রচার’

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ভাঙার তথ্যটি সঠিক নয়ঃ অপপ্রচার’

BMTV Desk No Comments

মতিউল আলম , বিএমটিভি নিউজঃ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে—ময়মনসিংহ শহরের হরিকিশোর রায় রোডে শিশু একাডেমির নামে বরাদ্দকৃত  জমিতে  একটি পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ ভবন ভাঙা হচ্ছে, সেটিই নাকি কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় কিংবা তার পূর্বপুরুষের বাড়ি। তবে তথ্যটি সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গবেষক ও স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা।

গত বুধবার বিকেল ৪টায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তাঁর কার্যালয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মুফিদুল আলম বলেন, ‌‘এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে একটি গোষ্ঠী মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।’তিনি বলেন, ‘যে ভবনটি নিয়ে এই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বা তার পূর্বপুরুষের পৈতৃক বাড়ি নয়। সংশ্লিষ্ট সকল খতিয়ান ও রেকর্ডপত্র, যেমন সিএস, আরএস ইত্যাদি যাচাই করা হয়েছে। প্রতিটি খতিয়ানেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এই সম্পত্তিতে সত্যজিৎ রায় বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের নাম নেই। বর্তমানে আরএস রেকর্ডে এটি বাংলাদেশ সরকারের নামে লিপিবদ্ধ।’ডিসি মুফিদুল আলম বলেন, ‘২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির নামে এই জমিটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় বন্দোবস্ত করা হয় এবং তাদের নামে দলিল ও খতিয়ান রয়েছে। শিশু একাডেমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ভবনটি ভাঙার কার্যক্রম শুরু করেছে, যা সরকারি বিধি অনুযায়ী সম্পূর্ণ বৈধ। এতে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়নি।’

গবেষক স্বপন ধর জানান, বাড়িটি মূলত রনদা প্রসাদের অস্থায়ী বাসভবন ছিল। সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে এই স্থাপনার কোনো যোগসূত্র নেই। বিভ্রান্তির মূল কারণ—এই রোডের নাম সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরিকিশোর রায়ের নামে, কিন্তু এই নির্দিষ্ট ভবনটি তাদের নয়।বাড়িটি গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় ভবনটি সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে এবং নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সম্প্রতি সেই কাজ শুরু হলে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে—ভেঙে ফেলা হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি।বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল ও কবি ইয়াজদানি কোরাইশী কাজল জানান, এই বাড়িতে কখনো সত্যজিৎ রায়ের পরিবার থাকতেন না। এটি ছিল জমিদারির এক কর্মকর্তার বাসভবন। দেশভাগের পর এটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে।
তারা আরও জানান, হরিকিশোর রায় রোডের পাশেই ‘দুর্লভ ভবন’ নামে পরিচিত বাড়িটিই ছিল সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের পৈতৃক নিবাস। বর্তমানে সেখানে ‘দুর্লভ ডালিয়া টাওয়ার’ নামে একটি সুউচ্চ ভবন দাঁড়িয়ে আছে। ফলে যে ভবনটি ভাঙা হচ্ছে, সেটিকে সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি বলে উল্লেখ করা সম্পূর্ণ ভুল।

ময়মনসিংহে সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ভাঙার বিষয়টি অপপ্রচার ছিল বলে জানান শিশুতীর্থ আনন্দধ্বনি সংগীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. মামুনুল ইসলাম।বুধবার (১৬ জুলাই) এক বক্তব্যে তিনি একথা জানান।মামুনুল ইসলাম বলেন, “ময়মনসিংহে শিশু একাডেমির জন্য নির্ধারিত স্থানের পুরাতন একটি ভবন ভাঙা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।”
তিনি বলেন, “যতটুকু জানি এই বাড়িটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়দের কোন সম্পর্ক নেই। এই বাড়িটির তেমন কোন শক্তিশালী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও নেই। পূর্বে বাড়িটি জমিদার শশীকান্ত বাবুর কর্মচারীদের আবাসস্থল ছিলো। অথচ আমাদের কিছু সাংবাদিক, তাদের মারফতে জাতীয় কিছু পত্রিকা এবং অতি উৎসাহী ফেসবুক এক্টিভিস্টের কারণে বিষয়টি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাড়িটি বহু আগেই ব্যবহার অযোগ্য এবং ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় এটি ভেঙে শিশু একাডেমির ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়েও ভবন নির্মাণ পিছিয়ে যায় নানা কারণে। এবার বরাদ্দ পাওয়ার পর নতুন ভবন নির্মাণ শুরুর প্রক্রিয়া হিসেবে ভঙ্গুর ঝুকিপূর্ণ ভবনটি ভাঙা শুরু হলে না জেনে বুঝেই কিছু মানুষ সরব হয়ে ওঠে ভবনটি নিয়ে।”
তিনি বলেন, “এই বাড়ি ভাঙা নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে কড়া প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে, ভারতের আন্দবাজার পত্রিকাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট হয় যেখানে নানা ভাবে প্রচার হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ভেঙে ফেলছে বাংলাদেশ সরকার।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়টি নিয়ে কড়া সমালোচনা করে কেন্দ্রীয় সরকারকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ারও অনুরোধ করেছেন বলেও জানা যায়।
শিশু একাডেমীর ভবন নির্মাণের জন্য যে পুরাতন ভবনটি ভাঙ্গা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে এই বাড়ির সাথে সত্যজিৎ পরিবারের কোনই সম্পর্ক নেই। এ তথ্য জানিয়েছেন সুজন, ময়মনসিংহ মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলী ইউসুফ গত ১৫ জুলাই তার ফেসবুকে ওয়ালে  ।কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ভাঙার তথ্যটি সঠিক নয়ঃ অপপ্রচার’।
জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মেহেদী জামান বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ভবন ভাঙার কাজ আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এই জমিটি শিশু একাডেমি নামে বরাদ্দ আছে। সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে এই স্থাপনার কোনো সম্পৃক্ততা নাই।তিনি আরও জানান, এই বিষয় নিয়ে জেলা প্রসাশকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়েছে। তবে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই স্থাপনা ভাঙার কাজ স্থগিত করা হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আজিমুদ্দিন বলেন, এই জমিটি শিশু-একাডেমির নামে বন্দোবস্ত দেওয়া আছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই বিভ্রান্তি অপসারণ করে দ্রুত শিশু একাডেমির নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা উচিত। তারা বলেন, এই শহরের সাংস্কৃতিক চর্চা ধরে রাখতে নতুন ভবনের কোনো বিকল্প নেই। আবেগ নয়, প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।##

মতিউল আলম

LATEST POSTS