মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর
খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। অথচ এই খাদ্য উৎপাদনেই এখন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু ভয়াবহ বালাইনাশকের কারণে। অধিক ফলন নিশ্চিত করতে কৃষিতে হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগ-পোকা ও অনিয়ন্ত্রিত বালাইনাশকের ব্যবহার। আর এসব বিষাক্ত বালাইনাশক সরাসরি প্রভাব ফেলছে কৃষক, ভোক্তা ও পরিবেশের ওপর।ক্যান্সারসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরিপ (২০১৫–১৭) অনুযায়ী, তাদের হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই তথ্যই বলছে— বিষ কীভাবে খাদ্যচক্রে ঢুকে মানুষ ও পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে।
এই বাস্তবতায় দেশে প্রথমবারের মতো ‘অধিক বিপজ্জনক বালাইনাশক’ চিহ্নিত করলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস ও তার গবেষক দল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত ৮টি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে দেশে নিবন্ধিত ৩৪৩টি সক্রিয় উপাদান বিশ্লেষণ করে মোট ২৫টি অধিক বিপজ্জনক বালাইনাশক চিহ্নিত করে গবেষক দল। এই ২৫টি বালাইনাশকের মধ্যে ১১টি কীটনাশক, ৭টি ছত্রাকনাশক, ৫টি আগাছানাশক এবং ২টি ইঁদুরনাশক। এর আওতায় প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক পণ্যে এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়।
বুধবার (৩০ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকায় অবস্থিত তুলা ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে অধিক বিপজ্জনক বালাইনাশক (HHPs) ও রাসায়নিকের উন্নত ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক’ শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণাটি সম্পর্কে এসব তথ্য তুলে ধরেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. গোপাল দাস।গবেষণায় দেখা গেছে, মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ৯টি অধিক বিপজ্জনক বালাইনাশক হলো- এবামেকটিন, ক্লোরপাইরিফস, প্যারাকুয়াট, গ্লাইফোসেট, গ্লুফোসিনেট অ্যামোনিয়াম, কার্বেন্ডাজিম, প্রোপিকোনাজোল, জিঙ্ক ফসফাইড ও ব্রোমাডিওলন। এছাড়া আরও কিছু বালাইনাশকের মধ্যম বা সীমিত ব্যবহার দেখা গেছে।
অন্যদিকে, সাইফ্লুথ্রিন, বিটা-সাইফ্লুথ্রিন, ট্রায়াজোফস, এডিফেনফস, ফ্লুলসিলাজোল নামক বালাইনাশকের তেমন কোনো মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার পাওয়া যায়নি। যা এখনই নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মত দেন গবেষকগণ।
এসব বালাইনাশকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ড. গোপাল বলেন, এগুলো মানবদেহে ক্যান্সার, কিডনি বিকলতা, হৃদরোগ, ফুসফুসের জটিলতা এমনকি প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীকূল এবং পরিবেশেও দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া তৈরি করে। এসব বালাইনাশকের একটি বড় অংশ স্থায়ী জৈব দূষক (Persistent Organic Pollutants) হিসেবে পরিবেশে জমে থাকে বছরের পর বছর।
গবেষণা শেষে ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে দেশব্যাপী ১৪টি অঞ্চলে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ, র্যালি, মাঠ প্রদর্শনী ও ১০টি আঞ্চলিক কর্মশালা আয়োজন করা হয়। কৃষক, বালাইনাশক ডিলার ও কৃষি কর্মকর্তাদের সচেতন করতে নেওয়া হয় কার্যকর উদ্যোগ।
গবেষক ড. গোপাল দাস আরও জানান, সরকারি মহলে এখন যা করা দরকার তা হলো- অধিক বিপজ্জনক বালাইনাশকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল বা নবায়ন বন্ধ করতে হবে। বিকল্প নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডিলারদের লাইসেন্স কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সাথে মাঠ পর্যায়ে বর্তমান আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে এই ক্ষতির হাত থেকে দেশের কৃষক ও কৃষি খাতকে রক্ষা করা সম্ভব। অধিক বিপদজনক বালাইনাশকের এই চিহ্নিতকরণ ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে টেকসই কৃষি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদী বাকৃবির এই গবেষক।
বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ কারিগরি ও নীতি উপদেষ্টা মারটিজিন ভন দে গ্রোয়েপ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডিএই’র প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম, বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) পরিচালক অধ্যাপক ড. এম. হাম্মাদুর রহমান।
কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য দেন বাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন। এছাড়াও দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞানীগণ, ডিএই কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কৃষক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম বলেন, আমরা বর্তমান প্রচলিত বালাইনাশক আইনের সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছি, যাতে জনগণকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি। তবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা আমরা অকপটে স্বীকার করি। এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ক্ষতিকর কীটনাশকের অতি ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে— এগুলো ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতি রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এসব বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা ২০২৫ সালে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। আমরা অবশ্যই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাই, তবে তা যেন পরিবেশের ক্ষতি করে না হয়, সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য জৈব কীটনাশক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছি।